Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪
বরো-১

ঘরের ঝগড়া, প্রার্থী-পদ প্রত্যাহার, দল ভাঙানো, হাতের কাছে সব মজাই

পুর-পরিষেবা পাওয়া না পাওয়ার ভিত্তিতেই মূলত লড়াই পুরভোটে। ব্যতিক্রম কলকাতা পুরসভার এক নম্বর ওয়ার্ড। পরিষেবার বদলে সেখানে তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব নিয়ে আলোচনাই বেশি। উত্তর কলকাতার সীমান্তে এক নম্বর বরোর এই ওয়ার্ডে তৃণমূল বনাম বিক্ষুদ্ধ তৃণমূলের ব্যালটের লড়াইয়ের আগেই শুরু হয়ে গিয়েছে পেশি শক্তির লড়াই। যা পৌঁছেছে বোমা-গুলি পর্যন্তও।

কৌশিক ঘোষ
শেষ আপডেট: ২৭ মার্চ ২০১৫ ০০:০১
Share: Save:

পুর-পরিষেবা পাওয়া না পাওয়ার ভিত্তিতেই মূলত লড়াই পুরভোটে। ব্যতিক্রম কলকাতা পুরসভার এক নম্বর ওয়ার্ড। পরিষেবার বদলে সেখানে তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব নিয়ে আলোচনাই বেশি। উত্তর কলকাতার সীমান্তে এক নম্বর বরোর এই ওয়ার্ডে তৃণমূল বনাম বিক্ষুদ্ধ তৃণমূলের ব্যালটের লড়াইয়ের আগেই শুরু হয়ে গিয়েছে পেশি শক্তির লড়াই। যা পৌঁছেছে বোমা-গুলি পর্যন্তও। আর তারই আঁচ পড়েছে এলাকাবাসীর উপরেও। এখানে স্থানীয় কাউন্সিলর তৃণমূলের সীতা জয়সোয়ারা ফের মনোনয়ন পাওয়ায় ক্ষুদ্ধ তৃণমূূলেরই অপর নেতা জয়নাল আবেদিন। বাইক-বাহিনী নিয়ে ওয়ার্ডে রীতিমতো ‘দাপট-প্রচার’ চালাচ্ছেন আবেদিনের লোকজন। তাঁর দাবি, “আমিই যোগ্য প্রার্থী। দল মনোনয়ন না দেওয়ায় নির্দল হতে হয়েছে।” তা শুনে সীতাদেবীর বক্তব্য, “ওঁর লম্ফঝম্ফই সার। জয় আমার নিশ্চিত।” তৃণমূলের ওই কোন্দলে মজা লুটছেন বাম প্রার্থী রাজেন্দ্র গুপ্ত। বললেন, “নিরপেক্ষ ভোট হলে অবশ্যই সুবিধা পাব।”

লাগোয়া তিন নম্বর ওয়ার্ডে আবার তৃণমূূলের বর্তমান কাউন্সিলর ব্রজেন্দ্রকুমার বসুকে সরিয়ে প্রার্থী করা হয়েছে ২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর শান্তনু সেনকে। ২ নম্বর ওয়ার্ড এ বার মহিলা সংরক্ষিত হওয়াতেই ৩ নম্বরে সরানো হয়েছে শান্তনুকে। যা নিয়ে এলাকার এক তৃণমূল নেতা বললেন, “শান্তনুর জন্য ‘শহিদ’ করা হল ব্রজেন্দ্রবাবুকে। আর আমাদের বলতে হচ্ছে, তিনি অসুস্থ।”

কাশীপুর, বি টি রোডের একটি অংশ জুড়ে ৬ নম্বর ওয়ার্ড। এখানকার রাজনৈতিক পরিচিতিও এ বার একটু বদলেছে। কংগ্রেসের দুর্গ বলে পরিচিত ওই ওয়ার্ডের দীর্ঘদিনের কাউন্সিলর সুমন সিংহ এ বার দল বদলে তৃণমূলের প্রার্থী। স্বভাবতই দ্বিধায় ভোটদাতারা। এখন প্রশ্ন কংগ্রেস না ব্যক্তি সুমন সিংহ, কাকে ‘মনে’ ধরবে এলাকাবাসী। তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী নবাগতা কংগ্রেস প্রার্থী তারানা ওয়াহিদার কথায়, “এখানকার মানুষ কংগ্রেসকেই চেনেন। সেটাই আমার মূল হাতিয়ার।” তারানা সরব হয়েছেন এলাকার নিকাশির বেহাল দশা নিয়ে। সুমন সিংহ অবশ্য তা মানতে নারাজ। তাঁর বক্তব্য, “সারা বছর মানুষের পাশে থাকি। তাই জেতার ব্যাপারে আমি আশাবাদী।” আসলে এত দিন বিরোধী থাকলেও এ বার সরকারি দলের সাহায্য মেলায় টগবগে মেজাজেই রয়েছেন সুমনদেবী।

নজর রাখতে হবে এই বরোর ৮ নম্বর ওয়ার্ডে। গত পুরভোটে তৃণমূল প্রার্থীর জয়ের ব্যবধান ছিল মাত্র ১৮২ ভোট। গত বছর লোকসভা ভোটে তা বেড়ে হয় ১২০০। দল প্রার্থী না করায় ওই ওয়ার্ডের তৃণমূল কংগ্রেস নেতা মানস কর দল ছেড়ে বিজেপির প্রার্থী হয়েছিলেন। কিন্তু বৃহস্পতিবার মনোনয়ন পত্র প্রত্যাহারের শেষ দিনে সরে দাঁড়ান তিনি। তাঁর কথা, “আমার পুরনো দল তৃণমূলের অনেকেই আমাকে সরে দাঁড়াতে অনুরোধ করেছিলেন। তাই মনোনয়ন প্রত্যাহার করেছি।” এ প্রসঙ্গে রাজ্য বিজেপির সাধারণ সম্পাদক অসীম সরকার বলেন, “মনোনয়ন জমা দেওয়ার পর থেকেই মানসবাবুর উপর

মানসিক নির্যাতন চালাচ্ছিলেন স্থানীয় তৃণমূল নেতৃত্ব। বুধবার রাতে তাঁর বাড়িতে চড়াও হয়ে ভয় দেখায় কিছু দুষ্কৃতী। বাধ্য হয়েই মনোনয়ন প্রত্যাহার করেছেন মানসবাবু।” তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় অবশ্য বলেন, “মানস কর আমাদের কর্মী ছিলেন। উনি বুঝতে পেরেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে রাজ্যে উন্নয়নের কাজে সামিল হওয়া দরকার।”

এই অবস্থায় ৮ নম্বর ওয়ার্ডে বিজেপির কোনও প্রার্থী রইলেন না। তৃণমূল প্রার্থী পার্থ মিত্রের পক্ষে সেটা যে কিছুটা স্বস্তির, তা নিয়ে সন্দেহ নেই।

পাশাপাশি সামনে আসছে অন্য একটি প্রশ্নও। তা হল, অন্তর্ঘাত। তৃণমূলে থাকাকালীন এলাকার বিধায়ক তথা মন্ত্রী শশী পাঁজার ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত ছিলেন মানস। তাই এই ওয়ার্ডে অন্তর্ঘাতের আশঙ্কা উড়িয়ে দিচ্ছেন না অনেকেই। যদিও স্থানীয় কাউন্সিলর তথা তৃণমূলের প্রার্থী পার্থ মিত্র বলেন, “কে দল ছাড়লেন বা আমার বিরুদ্ধে দাঁড়ালেন, তা নিয়ে আমি আগ্রহী নই। মানুষের জন্য কাজ করেছি। করবও। আমি আমার জয়ের বিষয়ে নিশ্চিত।”

তৃণমূলের অন্দরে ক্ষোভ রয়েছে ৭ নম্বর ওয়ার্ডে মঞ্জুশ্রী চৌধুরী ফের মনোনয়ন পাওয়ায়। এলাকার কয়েকজন তৃণমূল কর্মীর কথায়, “কোথাও অসুস্থ না হলেও সরানো হয়েছে প্রার্থীকে। আর যিনি প্রকৃতই অসুস্থ, তাঁকে এখানে প্রার্থী করা হল।” এতে এলাকার ক্ষতি হবে বলেই মত তাঁদের। মঞ্জুশ্রীদেবী অবশ্য বলেন, “এ সব অপপ্রচার। কান দিই না।” এখানে বাম প্রার্থী সিপিএমের সলিল চট্টোপাধ্যায়।

এক সময় কাউন্সিলর ছিলেন তিনি। তাই লড়াইটা একপেশে হচ্ছে না বলেই দাবি পড়শিদের।

তবে পরিষেবার হাল কেমন ওই বরোর ওয়ার্ডগুলিতে?

এখানে এলাকার বেশির ভাগ ওয়ার্ডে জল জমে থাকার সমস্যাই প্রধান। এক নম্বর ওয়ার্ডে কিছু এলাকায় রাস্তার একধারে রয়েছে খোলা নর্দমা। কোথাও আবার বড় বস্তি অঞ্চলে জলের কল কম। অভিযোগ রয়েছে পুকুর সংস্কার নিয়েও। কাউন্সিলর অবশ্য ওই সব ঘাটতির কথা স্বীকার করে নিয়েছেন। দমদম স্টেশন সংলগ্ন ২ নম্বর ওয়ার্ডেরও মূল সমস্যা নিকাশির। স্থানীয় রায়পাড়া এলাকার বাসিন্দা জয় সেন অভিযোগ করলেন, “জল জমাটাই এখানে সমস্যা।” একই বক্তব্য সিপিএম প্রার্থী শান্তা সেনেরও। বললেন, “পেয়ারাবাগানের কাছে পুকুর বুজিয়ে প্রোমোটিং হচ্ছে।” এ কথা অস্বীকার করে তৃণমূল কাউন্সিলর শান্তনু সেন অবশ্য বলেন, “কেইআইআইপি প্রকল্পে কাজ হওয়ায় জল জমার সমস্যা অনেকটাই মিটেছে।” এই ওয়ার্ডে এ বার তৃণমূলের প্রার্থী ৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর পুষ্পালি সিংহ।

৩ নম্বর ওয়ার্ডের এক বাসিন্দা আশিস মুখোপাধ্যায় জানালেন, মিল্ক কলোনির রাস্তায় বুলেভার্ড নির্মাণের পরিকল্পনা থাকলেও তা হয়নি। বাসিন্দাদের একাংশের অভিযোগ রয়েছে জঞ্জাল অপসারণ নিয়েও। এই ওয়ার্ডের সিপিএমের প্রার্থী কনীনিকা বসু (ঘোষ) বলেন, “আমাদের আমলে নিকাশির যে পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল সেটাই রয়েছে। বাড়তি কিছু কাজ হয়নি। অনেক জায়গাতেই জল জমে যায়।”

এ দিকে ৪ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা সুপ্রিয় ঘোষের বক্তব্য, “ইন্দ্রলোক হাউজিং এস্টেটের সংলগ্ন নর্দমা খোলা এবং নোংরা। ফলে বাড়ছে মশার উপদ্রব।” সিপিএম প্রার্থী নমিতা দাসের মতে, কাজ না হওয়ার ফলেই এই অবস্থা। বর্তমান কাউন্সিলর পুষ্পালি অবশ্য এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। ৫ নম্বর ওয়ার্ডের খেলাত্‌বাবু লেনের এক বাসিন্দা নন্দা মিত্র বলেন, “টালাপার্কের রক্ষণাবেক্ষণে ঘাটতি আছে।” যা স্বীকার করে স্থানীয় কাউন্সিলর এবং বরো চেয়ারম্যান তরুণ সাহা বলেন, “এই সমস্যা নিয়েই আমি জেরবার। ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE