Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

আইনি সাফাইয়েই থমকে দূষণ পর্ষদের শব্দবাজি অভিযান

চোর পালানোর পরে কোনও কোনও গৃহস্থের বুদ্ধি বাড়ে। আর শব্দবাজি নিয়ে খারাপ কিছু ঘটলে তবেই যেন নড়েচড়ে বসে পশ্চিমবঙ্গ দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ!

সুরবেক বিশ্বাস
শেষ আপডেট: ৩০ অগস্ট ২০১৬ ০১:৫৬
Share: Save:

চোর পালানোর পরে কোনও কোনও গৃহস্থের বুদ্ধি বাড়ে। আর শব্দবাজি নিয়ে খারাপ কিছু ঘটলে তবেই যেন নড়েচড়ে বসে পশ্চিমবঙ্গ দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ!

যেমনটা ফের ঘটল বিজয়গড়ে রবিবার এক বৃদ্ধার মৃত্যুতে শব্দবাজির তাণ্ডবে হৃদ্‌রোগের অভিযোগ ওঠার পরে। বিজয়গড়ে মৃত পূর্ণিমা মৈত্রের বাড়ির সামনে চকোলেট বোমা ফেটেছিল বলে অভিযোগ। দক্ষিণ ২৪ পরগনার চম্পাহাটি থেকে দিন কয়েক আগে সেগুলি কিনে আনা হয় বলে স্থানীয় একটি সূত্রে জানা গিয়েছে। এই ঘটনার পরে নড়েচড়ে বসে পর্ষদ জানিয়েছে, এ বার তারা শব্দবাজির বিরুদ্ধে অভিযানে নামবে। পূর্ণিমাদেবীর মৃত্যুর প্রায় ১৬ ঘণ্টা পরে সোমবার পর্ষদের এক শীর্ষ কর্তা বলেন, ‘‘খুব খারাপ ঘটনা। আসলে শব্দবাজির বিষয়টি বিচারাধীন।’’

কিন্তু শারদোৎসবের বাকি আর মাত্র ৪০ দিন। তবু এ বছর এখনও এই অভিযান হয়নি কেন? পর্ষদের তরফে আইনি জটিলতার সাফাই দেওয়া হচ্ছে। অথচ, পর্ষদের অবসরপ্রাপ্ত মুখ্য আইন আধিকারিক ও পরিবেশকর্মী বিশ্বজিৎ মুখোপাধ্যায় জানাচ্ছেন, অভিযানের ক্ষেত্রে আইনগত কোনও বাধা নেই। এমনকী, পর্ষদেরই গত বছরের বিজ্ঞপ্তি মেনে রাজ্য পুলিশ নিজেদের মতো ওই অভিযান চালাচ্ছে। অথচ অভিযান দূরে থাক, বেআইনি বাজি বাজেয়াপ্ত করার অভিযান চালানোর ব্যাপারে এ বছর পুলিশের সঙ্গে এখনও পর্যন্ত সমন্বয় বৈঠকও করেনি পর্ষদ।

সারা বাংলা আতসবাজি উন্নয়ন সমিতির চেয়ারম্যান বাবলা রায় এ দিন জানান, ইতিমধ্যেই ১২০ কোটি টাকার শব্দবাজি তৈরি হয়ে গিয়েছে। প্রস্তুতকারকদের ঘর থেকে শীঘ্রই সেই বাজি পাইকারদের কাছে ঢুকবে। বাবলাবাবুর বক্তব্য, রাজ্যে এ বার আড়াইশো কোটি টাকারও বেশি মূল্যের শব্দবাজি তৈরি হবে। তাঁর দাবি, গত বছর অক্টোবরে জাতীয় পরিবেশ আদালত জানিয়েছিল, এ রাজ্যে বাজির শব্দসীমা ১২৫ ডেসিবেল। ওই সীমা মাথায় রেখেই শব্দবাজি তৈরি করা হয়েছে বলে বাবলাবাবুর বক্তব্য।

পর্ষদের পাল্টা যুক্তি, বাজির শব্দসীমার বিষয়টি জাতীয় পরিবেশ আদালতে বিচারাধীন। যতক্ষণ না তার ফয়সালা হচ্ছে, ততক্ষণ পশ্চিমবঙ্গে বাজির শব্দসীমা ৯০ ডেসিবেল বলেই গণ্য হবে। ১৯৯৭ থেকে পশ্চিমবঙ্গে বাজির শব্দসীমা ৯০ ডেসিবেল। এই শব্দসীমার মধ্যে খেলনা পিস্তলে ফাটানোর ক্যাপ ছাড়া অন্য শব্দবাজি তৈরি কার্যত অসম্ভব। সে দিক থেকে পশ্চিমবঙ্গে শব্দবাজি নিষিদ্ধ।

পর্ষদের অবসরপ্রাপ্ত মুখ্য আইন আধিকারিক ও বর্তমানে পরিবেশকর্মী বিশ্বজিৎ মুখোপাধ্যায়ও বলছেন, জাতীয় পরিবেশ আদালত ১২৫ ডেসিবেলের কথা বললেও গত বছর কালীপুজোর ঠিক আগে পর্ষদ ৯০ ডেসিবেলকে বাজির শব্দসীমা বলে উল্লেখ করে বিজ্ঞপ্তি জারি করেছিল। জাতীয় পরিবেশ আদালত সেই বিজ্ঞপ্তি খারিজ করেনি। গোটা বিষয়টি নিয়ে মামলা চলছে।

তা হলে শব্দবাজির বিরুদ্ধে পর্ষদ অভিযানে নামেনি কেন?

পর্ষদের চেয়ারম্যান কল্যাণ রুদ্র এ দিন বলেন, ‘‘আমরা কোনও পদক্ষেপ করলেই আতসবাজি উন্নয়ন সমিতি আদালতের দ্বারস্থ হচ্ছে। সেই জন্যই অভিযান চালানো যায়নি।’’

কিন্তু এর মধ্যেই তো বিজয়গড়ের ঘটনা ঘটল! কল্যাণবাবুর বক্তব্য, ‘‘আদালতকে সব জানিয়ে অভিযানের অনুমতি চেয়ে আবেদন করব। অনুমতি নিয়ে শব্দবাজির বিরুদ্ধে অভিযান চালানো হবে।’’

তবে পর্ষদ এত দিন হাত গুটিয়ে বসে থাকলেও রাজ্য পুলিশ কিন্তু ইতিউতি অভিযান চালিয়েছে। তাদের বক্তব্য, গত বছর কালীপুজোর মুখে জারি করা পর্ষদের নির্দেশিকা অনুযায়ীই পদক্ষেপ করা হচ্ছে। রাজ্য পুলিশের এডিজি (আইনশৃঙ্খলা) অনুজ শর্মা বলেন, ‘‘আমরা বেআইনি বাজির বিরুদ্ধে অভিযান চালাচ্ছি। প্রচুর বাজি বাজেয়াপ্তও করা হয়েছে।’’ তবে যা তৈরি হয়েছে ও হচ্ছে, তার তুলনায় বাজেয়াপ্ত হওয়া বাজির পরিমাণ নিতান্ত কম বলে আতসবাজি উন্নয়ন সমিতির একটি সূত্রের খবর।

বিশ্বজিৎবাবুর বক্তব্য, ‘‘এখন অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। অভিযান শুরু করতে হয় জুন মাসের গোড়ায়। বিশ্বকর্মা পুজোর ঠিক আগে থেকে ঘন ঘন অভিযান চালাতে হয়। অতীতে পর্ষদ এ ভাবে পদক্ষেপ করেই সাফল্য পেয়েছে।’’ আর এক পরিবেশকর্মী নব দত্তের কথায়, ‘‘বিজয়গড়ে যা ঘটেছে, তার জন্য মূলত পর্ষদের নিষ্ক্রিয়তা দায়ী।’’ বেআইনি শব্দবাজির কারখানা নিয়ে জাতীয় পরিবেশ আদালতের পূর্বাঞ্চলীয় বেঞ্চে মামলা করেছেন বিশ্বজিৎবাবু। ২৩ সেপ্টেম্বর মামলার পরবর্তী শুনানি। বিশ্বজিৎবাবু জানান, ওই দিন পরিবেশ আদালতে বিজয়গড়ের ঘটনা জানিয়ে সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ জারির বিষয়ে আবেদন করবেন তিনি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

West Bengal pollution control fire crackers
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE