Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪

চিকিৎসক পারেন না, দালাল পারে

স্বাস্থ্যকর্তাদের একাংশ স্বীকার করে নিয়েছেন, সর্ষের মধ্যেই রয়েছে ভূত। হাসপাতালের কর্মীদের একাংশই এই দালালচক্রের সঙ্গে জড়িত থাকায় কিছুতেই এই চক্র ভাঙা যাচ্ছে না বলে জানাচ্ছেন তাঁরা।

সুকুমার চট্টোপাধ্যায়। নিজস্ব চিত্র

সুকুমার চট্টোপাধ্যায়। নিজস্ব চিত্র

সোমা মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১২ জুন ২০১৭ ০২:০৪
Share: Save:

অবিলম্বে অস্ত্রোপচার না করলে যে রোগীকে বাঁচানো যাবে না বলে জানিয়ে দিয়েছিলেন চিকিৎসক, সেই রোগীরই অস্ত্রোপচারের ডেট পড়ল ন’মাস পরে!

তবে ‘বিকল্প’ পথও ছিল। দালালের হাতে নগদ ৩৫ হাজার টাকা তুলে দিতে পারলে ডেট এগিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি পেয়েছিল রোগীর পরিবার। অভিযোগ, সেই প্রস্তাব এসেছিল অন্য হাসপাতালের এক চতুর্থ শ্রেণির কর্মীর কাছ থেকে। ঠিক সময়ে টাকার জোগাড় করে উঠতে পারেননি তাঁরা। যখন জোগাড় হল, ততক্ষণে দালালের ‘রেট’ও দ্বিগুণ হয়ে গিয়েছে। সেই টাকা ছিল না নিম্নবিত্ত পরিবারটির হাতে। কিন্তু এর দিন কয়েকের মধ্যে মাঝরাতে হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হন রোগী। বাধ্য হয়ে তাঁকে ভর্তি করা হয় বাড়ির কাছে একটি বেসরকারি হাসপাতালে। নিজের পরিবারকে আর ভোগান্তির মধ্যে ফেলেননি ৬৭ বছরের সুকুমার চট্টোপাধ্যায়। ওই হাসপাতালেই মৃত্যু হয় তাঁর।

এই ঘটনায় একাধিক প্রশ্ন সামনে এসেছে। প্রথমত, মুমূর্ষুও যদি ন’মাস পরে অস্ত্রোপচারের ডেট পান, তা হলে সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা বিনামূল্য হয়েও কতটা সুরাহা হচ্ছে গরিব রোগীদের? দ্বিতীয়ত, যেখানে রোগীর বিপুল চাপের কারণে পরিষেবা পেতে এমন দীর্ঘ সময় লাগছে, সেখানে কোন জাদুবলে ৩৫ হাজার টাকার বিনিময়ে অবিলম্বে ভর্তি করানোর ব্যবস্থা করা যায়?

আরও পড়ুন: ভুয়ো ডাক্তারের কারখানা শহরে

তাঁর প্রেসক্রিপশনে অস্ত্রোপচারের ডেট পড়েছে ন’মাস বাদে। নিজস্ব চিত্র

স্বাস্থ্যকর্তাদের একাংশ স্বীকার করে নিয়েছেন, সর্ষের মধ্যেই রয়েছে ভূত। হাসপাতালের কর্মীদের একাংশই এই দালালচক্রের সঙ্গে জড়িত থাকায় কিছুতেই এই চক্র ভাঙা যাচ্ছে না বলে জানাচ্ছেন তাঁরা। স্বাস্থ্য ভবনের এক শীর্ষ কর্তা বলেন, ‘‘সরকারি হাসপাতালে, বিশেষত কলকাতার মেডিক্যাল কলেজগুলিতে ‘বেড বুকিং’-এর ব্যবস্থা কিছুতেই বন্ধ করা যাচ্ছে না। হাসপাতালের সুপার এবং অধ্যক্ষরা অনেকেই কয়েকটি শয্যা আগাম বুক করে রেখে দেন। বহু ক্ষেত্রে বুক থাকে অপারেশন থিয়েটারও। ভিআইপি-দের ফোন এলে সেই শয্যা বা অপারেশন থিয়েটার কাজে লাগে। কিন্তু রোজই তো আর ভিআইপি-দের ফোন আসে না। তখন ভিতরের যোগসাজসে সেই শয্যাগুলিতেই রোগী ভর্তির ব্যবস্থা করে দেয় কিছু কর্মী। বিনিময়ে রোগীর পরিবারের কাছ থেকে টাকা আদায় করে তারা।’’

এ ক্ষেত্রেও কি তা-ই হয়েছিল? মৃত সুকুমারবাবুর মেয়ে সঙ্গীতা জানান, তাঁর বাবাকে আরজিকর মেডিক্যাল কলেজ থেকে রেফার করা হয়েছিল এসএসকেএমে। দ্রুত বাইপাস সার্জারি জরুরি সে কথাও লিখে দিয়েছিলেন আরজিকরের চিকিৎসকেরা। কিন্তু এসএসকেএমে আনার পরে জানানো হয়, লম্বা লাইন। তাই ২০১৮-র জানুয়ারি পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। বারবার অনুরোধ করেও ফল মেলেনি। স্থানীয় জনপ্রতিনিধির চিঠি নিয়েও গিয়েছিলেন তাঁরা। কিন্তু হাসপাতালের ডাক্তারেরা তাঁদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন বলে অভিযোগ। সঙ্গীতা বলেন, ‘‘এসএসকেএমে বলা হয়, ২০১৮-র জানুয়ারি পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। আরজিকরে এক দালাল অবশ্য বলেছিলেন, নগদ ৩৫ হাজার টাকা দিতে পারলে ভর্তি তো বটেই, দিন কয়েকের মধ্যে অস্ত্রোপচারের ব্যবস্থাও করা যাবে। তখনই অত টাকার ব্যবস্থা করার সামর্থ্য আমাদের ছিল না। তাই বাবাকে ভর্তিও করতে পারিনি।’’ সঙ্গীতার প্রশ্ন, ‘‘যেখানে আমার বাবার মতো মুমূর্ষু ন’মাসের আগে ডেট পাননি, সেখানে এক জন দালাল কী ভাবে এত দ্রুত ভর্তি বা অস্ত্রোপচারের ব্যবস্থা করতে পারবেন? তা হলে কি ধরে নিতে হবে এটাই দস্তুর? ভিতরে যোগাযোগ থাকলে সবই হয়?’’

এসএসকেএমে ভর্তির ব্যবস্থা কী ভাবে আরজিকরের দালাল করতে পারবে, উঠছে সেই প্রশ্নও। তা হলে কি সামগ্রিক ভাবে কোনও দালালচক্র রয়েছে এর পিছনে? পুলিশের বক্তব্য, এ ভাবে রোগী ভর্তির পিছনে একাধিক দালাল চক্র রয়েছে। আর প্রায় সব চক্রের পিছনেই রয়েছে হাসপাতালের কোনও না কোনও কর্মী। এক কর্তার কথায়, ‘‘হাসপাতালের ভিতরের লোকজন রয়েছে বলেই আমরা বারবার অভিযান চালিয়েও চক্রগুলিকে নির্মূল করতে পারছি না।’’

বিষয়টি মেনে নিয়েছেন স্বাস্থ্যকর্তারাও। এ ধরনের চক্র যে শুধু রোগী ভর্তির জন্য টাকা নেয় তা-ই নয়, তারা রোগীদের ভুল বুঝিয়ে বাইরের ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করতেও পাঠায়। রাজ্যের স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা দেবাশিস ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘সমস্যা জানি। বহু বার নানা ভাবে চেষ্টা করেও পরিস্থিতি বদলাচ্ছে না। আমরা সব মহলেই এ নিয়ে পরামর্শ চাইছি। পরিষেবা সকলের কাছে পৌঁছে দিতে গেলে দালালচক্র রুখতেই হবে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Doctor Middle man Hospital Patients Treatment
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE