শৈল্পিক: চিৎপুরের রাস্তা এ ভাবেই হয়ে উঠেছে শিল্পের পরিসর। ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী।
ঘিঞ্জি এলাকা, সরু রাস্তার দু’ধারে রয়েছে অজস্র দোকান। সারাদিনই যানজটে নাকাল।
চিৎপুর বললে চোখের সামনে ভেসে ওঠে এই চেহারাটাই। অথচ শহরের অন্যতম পুরনো এলাকা চিৎপুর এক কালে ছিল কলকাতার প্রাণকেন্দ্র। বই ছাপা থেকে প্রকাশনা, সোনার গয়না, পিতলের জিনিস থেকে শ্বেতপাথরের মূর্তি তৈরি— নানা সৃষ্টিশীল কাজে জমজমাট হয়ে থাকত দেবী চিতেশ্বরীর নামধারী এই জায়গা। যাত্রার রমরমাও তো দেখেছে এই চিৎপুরই। সে ছিল মুঘল ও ভিক্টোরিয়ান শৈলীর মিশেলে তৈরি বিত্তশালী ভারতীয়দের প্রাসাদোপম বাড়ির চিৎপুর। ঠাকুরবাড়ির চিৎপুর।
বিস্মৃতির ধুলো ঝেড়ে চিৎপুরের সেই সব কাহিনি শহরের সামনে হাজির করতে চলেছে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। আড্ডা, গান, চলচ্চিত্র, শৈল্পিক আদানপ্রদান নিয়ে হাজির হচ্ছে ‘চিৎপুর আর্ট ফেস্টিভ্যাল’-এর দ্বিতীয় সংস্করণ ‘চিৎপুরের গপ্পো’। শুক্রবার থেকে শুরু হওয়া এই উদ্যাপন চলবে আজ, রবিবার পর্যন্ত।
ওই সংগঠনের তরফে সুমনা চক্রবর্তী জানাচ্ছেন, রোজের ব্যস্ত যাতায়াতের পথে মানুষ ভুলে যান এই জায়গার সৌন্দর্য, ঐতিহ্যের কদর করতে। তাই কোনও গ্যালারি বা প্রেক্ষাগৃহ নয়, এই গল্প বোনা হবে চিৎপুর রোডের আশপাশের অলিগলি, স্কুল, গ্রন্থাগার, সাবেক বাড়ির দালান, এমনকী স্থানীয় থানাতেও। সামাজিক পরিসরকে শিল্পের মাধ্যম করে তোলাই এই প্রকল্পের লক্ষ্য। দর্শক তো বটেই, স্থানীয় বাসিন্দারাও এই ক’টা দিন চিৎপুরকে দেখতে পাবেন অন্য রূপে। জানতে পারবেন বহু অজানা তথ্য।
স্থানীয় বাসিন্দা, ব্যবসায়ীদের সঙ্গে দীর্ঘ আলাপচারিতা, ভাবনার আদানপ্রদানের ফসল এই উৎসব। মোট আট জন শিল্পী গত দেড় বছর ধরে একটু একটু করে তৈরি হয়েছেন এর জন্য। কেউ কাজ করেছেন চিৎপুর এলাকার স্টুডিও ফোটোগ্রাফি নিয়ে। কেউ আবার অনুপ্রেরণা হিসেবে বেছে নিয়েছেন জোড়াবাগান ট্র্যাফিক গার্ডের হেরিটেজ বাড়িটিকে। কেউ চান স্থানীয় ছাপাখানায় ব্যবহৃত শৈলীকে জনপ্রিয় করে তুলতে। এ ভাবেই এলাকার বাসিন্দাদের সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপন করেছেন শহরের শিল্পীরা।
শিল্পের মাধ্যমে কী ভাবে শহরের এই এলাকার বাসিন্দাদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ানো যায়, শিল্পকে অবলম্বন করে সমাজের বিভিন্ন অংশের পারস্পরিক সম্পর্কের রূপান্তর কী ভাবে ঘটছে, তার অনুসন্ধান করতেই জন্ম এই প্রকল্পের। শহরের এই অংশের বিচিত্র, সমৃদ্ধ ইতিহাসকে যত বেশি সম্ভব মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে চান উদ্যোক্তারা। তাঁরা চান, শিল্পের পীঠস্থান হিসেবে ফের পরিচিতি পাক চিৎপুর। পুনরুজ্জীবন হোক সাবেক শিল্পরীতির। সংগঠকেরা জানালেন, কোথাও যাওয়ার পথে পেরিয়ে আসা রাস্তা নয়, তাঁরা গন্তব্য হিসেবে তুলে ধরতে চান এই এলাকাটিকে।
তাই তিন দিনের এই উৎসবে থাকছে এলাকার আলাদা আলাদা অংশ একসঙ্গে জুড়ে গিয়ে একটাই সম্প্রদায় হয়ে ওঠার গল্প। পুরনো বাড়ির দালানের ইতিকথা। থাকছে ইতিহাস সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আলোচনা। হেরিটেজ বাড়ির বাসিন্দাদের জন্য রক্ষণাবেক্ষণের পরামর্শ। স্কুলপড়ুয়া ছাত্রীদের চোখে কী ভাবে ধরা দেয় স্থানীয় ইতিহাস? জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি পর্যন্ত হাঁটতে হাঁটতে জেনে নেওয়া যাবে তা-ও। সৌন্দর্যের সংজ্ঞা কী ভাবে বদলেছে সময়ের সঙ্গে? তা জানতে দেখে নেওয়া যাবে বিয়ের জন্য তোলা স্থানীয় মহিলাদের ছবির প্রদর্শনী। আর পুরো প্রকল্পটি ঘুরে দেখতে চাইলে সঙ্গে থাকবে রবি ঠাকুরের স্কুল বলে পরিচিত ওরিয়েন্টাল সেমিনারির পড়ুয়ারা। রবিবাসরীয় সন্ধ্যায় বাবু ‘কালচার’-এর স্মৃতি উস্কে দিয়ে পুরনো কলকাতার টপ্পা, ঠুমরিতে শেষ হবে এই উৎসব।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy