—প্রতীকী চিত্র।
পাটে ওঠার আগে খুনখারাবি রং ধরিয়ে যাচ্ছে সূর্য। সেই রং গুলে যাচ্ছে প্রবহমান বেগবতী গঙ্গায়। ঘাটের কিনারায় দাঁড়িয়ে রয়েছেন তিনি। কাঁধ পর্যন্ত নেমেছে দীর্ঘ কেশ। চিবুকে সদ্য পাক ধরা দাড়ি। কাঁধে জড়ানো শাল। প্রায় ধ্যানমগ্ন গঙ্গাঘাটের এই মানুষটিকে দেখে যোগী জ্ঞানে প্রণাম ঠুকে চলে যাচ্ছেন স্নানার্থীরা। তিনি, মির্জা বেগ আসাদুল্লা খান তাকিয়ে রয়েছেন অদূরের ভাসমান নৌকাগুলির দিকে। দূরে কোথাও মেহফিল শুরু হবে, তার আগে ঠুংরির বোল আর ঘুঙরুর মিঠে ধ্বনির আভাস ভেসে আসে। সব মিলিয়ে এক দৃশ্যকবিতা যেন। মুগ্ধ দৃষ্টিতে স্থির তাকিয়ে রয়েছেন গালিব সময়হারা হয়ে। ঘরে ফিরে যিনি লিখবেন, “মদেহ আজ় কাফ তারিক়-এ-মারিফত্ রা/ সরত্ গরদম ব-গরদ্ ইয়ঁ শশ্-জেহত্ রা।” যাকে বাংলা তরজমায় আব্দুল কাফি লিখছেন, “বারাণসী থেকে যে জ্ঞানের পথ পেয়েছে গালিব,/ সেই মারিফত্, সেই রাস্তা তুমি ছেড়ো না কখন,/ যে কোনও দিকেই চলে যেতে পারো, মুক্ত প্রাণ তুমি,/ কিন্তু এই সত্যদৃষ্টি ত্যাগ করে যেও না কদাচ...।”
নিজেকে দেওয়া কথা রেখেছেন এই ক্ষণজন্মা কবি। ভিতর থেকে ছেড়ে যাননি কখনও। এক টুকরো বারাণসী তিনি সঙ্গে রেখেছেন নিজের যাপন ও সৃষ্টিতে। আলোচ্য গ্রন্থের তরজমায় যেটুকু রয়েছে, বাকিটুকু বলা হয়েছে সূচনাকথায়— গালিবের অনেক বড় ভক্তের কাছেও যার সন্ধান ছিল না অনেক দিন। বল্লিমারান, যমুনা পারের মুশায়রার গালিব, লখনউয়ের গালিব এমনকি তাঁর কলকাতার বসত নিয়েও কত গল্প, উর্দু নজ়ম গজল, কথা উপকথা অতিকথার পঞ্চব্যঞ্জন আমাদের। কিন্তু আব্দুল কাফি, গালিবের এমন এক পর্ব পাঠকদের সামনে এই গ্রন্থে হাজির করলেন, যে পর্ব থেকে এখনও টাটকা অন্নের বাস।
চিরাগ়-এ দ্যয়র: দেবালয়ের চিরাগ মির্জা আসাদুল্লা খাঁ গালিব,
ভূমিকা ও তরজমা: আব্দুল কাফি
৫০০.০০
মান্দাস
১৮২৬-এ যাত্রা শুরু করে লখনউ কানপুর বানদা ইলাহাবাদ হয়ে নভেম্বর-শেষে বারাণসী পৌঁছেছিলেন গালিব। ছিলেন এক মাসের কিছু বেশি। এই সামান্য সময়ের মধ্যেই কাশীর আত্মাকে নিজের মধ্যে ধারণ করে লিখেছিলেন দু’শো ষোলো চরণের বিখ্যাত এই গ্রন্থ মসনভি চিরাগ়-এ দ্যয়র। উর্দু নয়, লিখেছিলেন ফারসি ভাষায়, মসনভির আঙ্গিকে। মসনভি অর্থাৎ ফারসিরই প্রাচীন রূপ, যেখানে পর পর দুই পঙ্ক্তির অন্ত্যমিল সাজিয়ে লেখা হয়, যা মূলত আখ্যানধর্মী। এই কাব্য যদিও প্রকাশিত হয় অনেক পরে। নিজের উর্দু কবিতার দিবান বা কাব্যসংগ্রহের জন্য গালিবকে অপেক্ষা করতে হয়েছে ১৮৪১ পর্যন্ত। ফারসি সংগ্রহ প্রকাশের জন্য আরও বেশি, ১৮৪৫ পর্যন্ত। গালিব রাজকবির মর্যাদা পাবেন আরও পাঁচ বছর পর।
অনুবাদক আব্দুল কাফি এই বইয়ের ভূমিকায় মনে করিয়ে দিয়েছেন যে, উর্দু ভাষার শ্রেষ্ঠ কবি হিসাবে গালিবকে আমরা মনে রাখলেও তাঁর নিজের পছন্দের ভাষাবাহন ছিল ফারসি, এবং ফারসিতেই রচনার সংখ্যা বেশি। যে সময় তাঁর ফারসি রচনার সম্ভার সেই কালখণ্ডটিকেও স্মরণ করানো হয়েছে। এই চিরাগ়-এ দ্যয়র লেখার সময়েই (কারণ বারাণসী ছেড়ে কলকাতা আসার পরেও সম্ভবত তিনি এর কিছু মসনভি রচনা করেন) তিনি যখন কলকাতা আসেন তার কয়েক বছর আগে রামমোহন রায়ের সংবাদপত্র মিরাত উল আখবার প্রকাশ বন্ধ হয়ে গিয়েছে ঠিকই, কিন্তু অন্য একাধিক ফারসি সংবাদপত্র তখনও প্রকাশিত হয়। গালিব লিখেছেন সেখানে। অকুণ্ঠ প্রশংসা করেছেন সেগুলির, দিল্লিতে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার কথাও বলেছেন। কাফি তাঁর সূচনাকথায় বলছেন, “বাংলা কবিতায় তখন ঈশ্বর গুপ্তের কাল। ব্যক্তির গভীর আত্ম-অনুসন্ধানের প্রয়াস তার আগেই গালিবের লেখায় ফুটে উঠেছে— অস্থির-কাতর ব্যক্তির নিঃসঙ্গতার এক বিশেষ ধরন সুখ ও দুঃখে মাখামাখি— তাঁর কবিতায় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে তখনই— পূর্ববর্তী ফার্সি কবিতার অতিশয়োক্তি-নির্ভর বিরাট ঐতিহ্যে যা অনুপস্থিত ছিল।”
এই মসনভিগুলির মধ্যে তাঁর নিজের ব্যক্তিজীবনের রক্তপাত, বেদনা, বিধুরতা, উল্লাস মিশে রয়েছে ঠিকই, কিন্তু এর প্রাণভ্রমরা লুকিয়ে রয়েছে ধর্মের প্রশ্নে এক নিষ্কম্প সত্যবান দীপের আলোয়। এই তরজমাগ্রন্থটি উৎসর্গ করা হয়েছে কবীর এবং তুলসীদাস অর্থাৎ গালিবের দুই পূর্বজ কাশীনিবাসীকে। আমাদের না মনে পড়ে পারে না, কোন সময় দাঁড়িয়ে এই দেবালয়ের বাতিকে নিষ্কম্প দেখছি আমরা, যেমনটা দেখেছি সন্ত কবীরের নিষ্কম্প আলোর রূপকথাকে। দেখছি এমন এক সময়ে, যেখানে ধর্মব্যবসার সঙ্গে রাজনীতির সম্পর্ক গভীর হয়ে অদ্ভুত এক আঁধারে ঢেকে যাচ্ছে সমসময়। বিভাজনের জিগিরে অকল্যাণের লোল বিহ্বলতার মধ্যে দাঁড়িয়ে গালিবের এই মসনভিগুলি মায়ার প্রলেপ লাগিয়ে দিচ্ছে পাঠকের ক্ষত চৈতন্যে। গালিব লিখছেন, “এত মনোহর আর এত অনুপম এ শহর—/ এমন-কি দিল্লিরও পছন্দ কাশী, যেন মনে মনে/ মুগ্ধতা জমিয়ে রাখে বারাণসী নগরীর প্রতি,/ হৃদয়ের শুভকামনার বার্তা জানায় নিভৃতে।” মোগল সুলতানাতের দিল্লি এবং কাশীকে কি অনায়াস বন্ধনে তিনি মিলিয়ে দিচ্ছেন, যে বন্ধনের তন্তুজাল স্রেফ ভালবাসায় গড়া।
লালনের সহজিয়া সমর্পণ, তাঁর মনশিক্ষার উপকরণগুলির এক উজ্জ্বল পূর্বসূরি ছিলেন কবীর— এ আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞান। আর তার চারশো বছরেরও বেশি সময় পরে বারাণসীর ঘাটে দাঁড়ানো সেই যোগীপ্রতিম গালিব সত্যিই তাঁর উত্তরাধিকার বহন করলেন চিরাগ়-এ দ্যয়র গ্রন্থে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy