Advertisement
৩০ এপ্রিল ২০২৪
Book Review

বিজ্ঞান প্রভাবিত করে ইতিহাসকে

ভারতের আধুনিক যুগের হিস্টেম-এর গবেষক ও চর্চাকারীরা বিগত কয়েক দশকের লেখালিখিতে প্রধানত তুলে ধরেছেন বিজ্ঞানের সামাজিক চরিত্র ও প্রকৃতি এবং সাংস্কৃতিক বহুমাত্রিকতার বৈশিষ্ট্য।

An image of an institution

পীঠস্থান: ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অব সায়েন্স, কলকাতা। আশির দশকের ছবি।

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৯ জুলাই ২০২৩ ০৯:৩৯
Share: Save:

দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস চর্চায় বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, পরিবেশ ও চিকিৎসা বিজ্ঞানের ইতিহাস (হিস্ট্রি অব সায়েন্স, টেকনোলজি, এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড মেডিসিন— সংক্ষেপে যাকে বলা হয় এইচআইএসটিইএম বা হিস্টেম) অতীতের এবং সমসাময়িক পর্বের সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রের পরিবর্তনকে নতুন আঙ্গিকে বুঝতে সাহায্য করেছে। ভারতের আধুনিক (এবং প্রাক্‌-আধুনিক) যুগের হিস্টেম-এর গবেষক ও চর্চাকারীরা বিগত কয়েক দশকের লেখালিখিতে প্রধানত তুলে ধরেছেন বিজ্ঞানের সামাজিক চরিত্র ও প্রকৃতি এবং সাংস্কৃতিক বহুমাত্রিকতার বৈশিষ্ট্য। তাঁদের আলোচনা থেকে স্পষ্ট হয়, ঔপনিবেশিক এবং উত্তর-ঔপনিবেশিক ভারতের রাজনীতি সমাজ ও সংস্কৃতির ইতিহাসের গভীরে ঢুকতে হলে তা হিস্টেম-কে বাদ দিয়ে আদৌ সম্ভব না।

সরকারি নীতির বিভিন্ন পর্যায়, জ্ঞানচর্চার প্রতিষ্ঠান স্থাপন, পেশাদারিত্বের বিকাশ ও স্তরবিন্যাস, জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রয়োগ ও বিস্তারে ভারতীয়দের এবং অ-ভারতীয়দের ভূমিকার স্বরূপ, জনস্বাস্থ্য বিষয়ক আইন ও পরিবেশ সংক্রান্ত নানা আইন ও বিধি নিষেধের প্রচলনের কাহিনি এই ইতিহাস চর্চার বিষয়বস্তু হিসাবে আমাদের জ্ঞানভান্ডারকে সমৃদ্ধ করেছে। ব্রিটিশ ভারতের বিজ্ঞান প্রযুক্তি চিকিৎসাবিদ্যা ও পরিবেশের ক্ষেত্রে যে সমস্ত পরিবর্তন এসেছিল তাদের কী রকম দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করা যথাযথ? ঔপনিবেশিক আমলকে কি ভারতে আধুনিক তথা পাশ্চাত্য বৈজ্ঞানিক কার্যকলাপের এবং আধুনিক ভারতের কারিগরি ও প্রযুক্তির বিকাশের খতিয়ান হিসাবে দেখাই যুক্তিযুক্ত? প্রাক্‌-ব্রিটিশ পর্বের জ্ঞানজগতের সঙ্গে এর সম্পর্ক কী রকম ছিল? উপনিবেশিক বিজ্ঞান রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক লক্ষ্যকে পূরণ করার ক্ষেত্রে কোন ভূমিকা নিয়েছিল? ভারতীয়রা কী ভাবে পাশ্চাত্য বিজ্ঞানকে গ্রহণ বা বর্জন করার কথা ভেবেছিলেন? স্বাধীনতা-পরবর্তী ভারতের ক্ষেত্রেই বা এ সব ক্ষেত্রে পরিলক্ষিত চিন্তাভাবনা ও কার্যকলাপের চরিত্র এবং তাৎপর্য কী রকম? এই সব অনুসন্ধানের ফলে উপনিবেশিক আমলে ভারতীয় সমাজের আধুনিকীকরণে বিজ্ঞানের সম্প্রসারণ কোন ভূমিকা ও কী ভাবে পালন করেছিল এবং স্বাধীন ভারতীয় রাষ্ট্র ও সমাজ, অর্থনীতি, সংস্কৃতির সঙ্গে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, পারিপার্শ্বিক পরিবেশের সম্পর্কের মূল্যায়নে সমাজবিজ্ঞানীদের চর্চা অভিনবত্ব অর্জন করেছে।

ভারতে হিস্টেম-চর্চার ক্ষেত্রে অন্যতম পথিকৃৎ জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত প্রথিতযশা অধ্যাপক দীপক কুমারের সম্মাননায় নিবেদিত, এবং বর্তমানে কলকাতার রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও দীপক কুমারের কৃতী ছাত্র সুভোব্রত সরকার সম্পাদিত এই আলোচিত গ্রন্থে সঙ্কলিত প্রবন্ধমালা এই বিষয়গুলোর অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। সব মিলিয়ে পনেরোটি প্রবন্ধকে সায়েন্স অ্যান্ড সোসাইটি, টেকনোলজি অ্যান্ড কালচার, এনভায়রনমেন্টাল ইস্যুজ় এবং মেডিক্যাল এনকাউন্টারস, এই চার ভাগে সাজিয়ে পেশ করা হয়েছে। প্রথম অংশের অন্তর্গত তিনটি প্রবন্ধে তিন জন বিশিষ্ট ব্যক্তির কার্যকলাপের মূল্যায়ন করেছেন আলোচকরা।

উনিশ শতকের ভারতে উচ্চশিক্ষিত এলিট সমাজের একাংশের ঝোঁক ছিল পাশ্চাত্যের জ্ঞান-বিজ্ঞান আয়ত্ত করার মধ্য দিয়ে পেশাদারি বিজ্ঞানচর্চা এগিয়ে নিয়ে যাওয়া ও প্রতিষ্ঠা অর্জন। আবার অনেকে চেয়েছিলেন পাশ্চাত্য বিজ্ঞানচর্চাকে দেশীয় ভাষায় প্রচার করে জনসাধারণের মধ্যে তার প্রসার। প্রথম অংশের অন্যতম প্রতিনিধি ছিলেন ক্যালকাটা মেডিক্যাল কলেজের মেটেরিয়া মেডিকা-র অধ্যাপক, চিকিৎসাবিজ্ঞানে উচ্চতর পাঠ লাভের জন্য ইংল্যান্ডে যাওয়া প্রথম ভারতীয়, ডারউইনের ছাত্র ও প্রাণিবিজ্ঞানের অধ্যাপক রবার্ট গ্রান্টের প্রিয় ছাত্র সূর্যকুমার গুডিভ চক্রবর্তী। তাঁকে নিয়ে আলোচনা করেছেন জন ম্যাথু।

দ্বিতীয় গোষ্ঠীর প্রতিনিধি বাংলার রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী এবং মহারাষ্ট্রের বালাজি প্রভাকর মোদক। এঁদের অবদানের বিশিষ্টতাকে তাঁদের প্রবন্ধে তুলে ধরেছেন যথাক্রমে শান্তনু চক্রবর্তী ও অভিধা ধুমটকর। শিজু শ্যাম ভারুগিস তাঁর প্রবন্ধে দেখিয়েছেন স্বাধীনতার-পরবর্তী সময়ে কেরালা শাস্ত্র সাহিত্য পরিষদের মতো প্রতিষ্ঠান কী ভাবে পপুলার সায়েন্স মুভমেন্ট-এর মধ্য দিয়ে বিজ্ঞান চর্চার গণতন্ত্রীকরণের ক্ষেত্রে অবদান রেখেছিল।

‘প্রযুক্তির ইতিহাস’ শিরোনামাঙ্কিত দ্বিতীয় ভাগে ওয়াই শ্রীনিবাস রাও মাদ্রাজে বিদ্যুতের আগমন ও তার সঙ্গে নগরায়ণের সম্পর্ক বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন, কী ভাবে ১৮৯৫ থেকে ১৯৩০-এর মধ্যে বিদ্যুৎ বিলাসিতা থেকে প্রয়োজন হয়ে উঠল। সুভোব্রত সরকার তাঁর প্রবন্ধে ঔপনিবেশিক শাসনের সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে ভারতের ‘এলিট’ সম্প্রদায় কর্তৃক আধুনিক প্রযুক্তিজ্ঞান আয়ত্ত ও ব্যবহারের ক্ষেত্রে শিবপুর এঞ্জিনিয়ারিং কলেজের সংগ্রামের ইতিহাস তুলে ধরেছেন। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ব্রিটেনের জায়গায় আমেরিকার সুপারপাওয়ার হিসাবে উত্থান, জিয়োলজিক্যাল সার্ভে-র ভূমিকা ইত্যাদির প্রেক্ষাপটে কপিল সুব্রহ্মণ্যম আলোচনা করেছেন কী ভাবে বিশ শতকের মধ্যভাগে ভারতের সেচক্ষেত্রে নলকূপের ব্যবহার গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল, সবুজ বিপ্লবকেও তা কী ভাবে প্রভাবিত করেছিল। পরাধীন ভারতে এবং স্বাধীনতার পরে ভারতে খনিজ তেলের ব্যবহারের বিবর্তনের ক্ষেত্রে রণভূমি থেকে মানুষের ঘরে ঘরে তার প্রয়োজন ব্যাপকতা লাভ করার ইতিহাসের অনুসন্ধান করেছেন শরন্ধ্যা জৈন।

চতুর্থ অংশে সাহারা আহমেদ মোটামুটি ভাবে ১৮৬০ থেকে ১৯৬০ পর্যন্ত বিস্তৃত কালপর্বে বাংলায় খনিজ শিল্পের বিকাশের আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক তাৎপর্যের পাশাপাশি পরিবেশের উপরে তার প্রভাব নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ অনুসন্ধান করেছেন। হিমাংশু উপাধ্যায় পশুচারণভূমি নিয়ে সরকারি নীতি ও উদ্ভিদবিজ্ঞানের ক্রিয়াকলাপ, ও নির্মল মাহাতো ১৮৯০ থেকে ১৯৬০-এর দশক পর্যন্ত পুরুলিয়ার পরিবেশের অবনতির বিষয়ে নতুন আলোকপাত করেছেন। চতুর্থ অংশের অন্তর্গত জয়ন্ত ভট্টাচার্যের প্রবন্ধে লিয়ো টলস্টয়-এর উপন্যাস দ্য ডেথ অব ইভান ইলিচ-এর প্রসঙ্গের উল্লেখ করে শরীর, অসুস্থতা ইত্যাদি বিষয়ে দার্শনিক ও নৈতিক প্রসঙ্গের আলোচনার বিস্তৃত প্রেক্ষাপটে আয়ুর্বেদ পদ্ধতির বিভিন্ন বিষয়ের বিশ্লেষণ করা হয়েছে। ঈশ্বর রাও তাঁর প্রবন্ধে বিশ শতকে মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সি অঞ্চলে যক্ষ্মা রোগের ইতিহাসের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করেছেন। ধ্রুব কুমার সিংহ হোমিয়োপ্যাথিক চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রাতিষ্ঠানিক রূপের সামাজিক ইতিহাসকে তুলে ধরেছেন। শেষ প্রবন্ধকার রাধা গায়েত্রী দিল্লির সেন্ট স্টিফেন’সকে মূল কেন্দ্র করে মেয়েদের স্বাস্থ্যরক্ষার ক্ষেত্রে মিশনারিদের অবদানের উপরে আলোকপাত করেছেন।

তথ্যনির্ভর, যুক্তিনিষ্ঠ, গবেষণাধর্মী, সুলিখিত প্রবন্ধগুলি হিস্টেম-চর্চায় নতুন ভাবনাচিন্তার রসদ জোগাবে। বিষয়ের অভিনবত্ব ও বহুমাত্রিকতা এই বইয়ের প্রশংসনীয় সম্পদ। বিস্তৃত গ্রন্থপঞ্জি এই বইয়ের আর একটি উল্লেখযোগ্য সম্পদ। সম্পাদকের সুচিন্তিত মূল্যবান ভূমিকা বইটির ঐশ্বর্য বৃদ্ধি করেছে। সূর্যকুমার গুডিভ সম্পর্কিত প্রবন্ধ চিকিৎসা বিষয়ক অংশের অন্তর্ভুক্ত করা যেত কি না এই প্রশ্ন উঠতে পারে, তবে তার ফলে বইয়ের সামগ্রিক মান কোনও ভাবে ক্ষুণ্ণ হয়েছে এ কথা বলা চলে না। দীপক কুমারের মতে, দু’টি পৃথক সংস্কৃতির (সায়েন্স ও হিউম্যানিটিজ়) যদি ‘এপিস্টেমোলজিক্যাল রিইউনিফিকেশন’ করার প্রয়োজন হয়, তবে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, পরিবেশ ও চিকিৎসাবিদ্যার ইতিহাস সেতু হিসাবে কাজ করবে। এই কথাকে স্বীকার করে নিয়ে নিঃসন্দেহে বলা চলে যে, সমাজবিজ্ঞানের অনুসন্ধিৎসু পাঠক, শিক্ষার্থী, গবেষক, বিজ্ঞানের সামাজিক ইতিহাসের চিন্তক এবং বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও গবেষক এবং সাধারণ পড়ুয়াদের জন্য এই বই আকর্ষণীয় একটি প্রকাশনা।

সুজাতা মুখোপাধ্যায়

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

book review Writer
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE