—প্রতীকী চিত্র।
ইতিহাসে হাতেখড়ি গ্রন্থমালার দ্বিতীয় পর্যায়ের তিনটি বই প্রকাশিত হল এক বছরের মধ্যেই, তা নিঃসন্দেহে সুসংবাদ। বাঙালি কাজ আরম্ভ করে, শেষ করে না, এই কথাটি অন্তত এ ক্ষেত্রে খাটেনি। এ বারের তিনটি বইয়েরই অভিমুখ অন্তত আংশিক ভাবে অর্থনীতির দিকে। চায়ের দুনিয়া বা নদীর চলা তো বটেই, যুদ্ধের নানা দিক বইটিও খোঁজ নিয়েছে যুদ্ধের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অর্থনৈতিক প্রভাবের।
তিনটি বই-ই সুলিখিত, তবে বিশেষত তৃতীয় বইটির ক্ষেত্রে সম্পাদনার অভাব কিছু কিছু ক্ষেত্রে পীড়াদায়ক। অবশ্য, গত দফার বইগুলির সঙ্গে এ বারের একটি পার্থক্য বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য— ছোটদের জন্য লেখা বই মানে যে তাদের ‘জ্ঞান দেওয়া’ বা ‘উপর থেকে কথা বলা’ নয়, বরং তাদের পূর্ণ পাঠক হিসাবে বিবেচনা করে একটা সমতলে এসে দাঁড়ানো, আলোচনার ভঙ্গিতে লেখা এগিয়ে নিয়ে যাওয়া, এই বইগুলি লেখার সময় লেখকেরা তা অনেক দূর অবধি মনে রেখেছেন।
ইতিহাসে হাতেখড়ি:চায়ের দুনিয়া
সুপূর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায় ও অন্বেষা সেনগুপ্ত
অর্থনীতির ইতিহাসের সব সূত্র বাঁধা থাকে একটি মূল প্রশ্নে— প্রকৃতির যে সম্পদ একটা সময় অবধি মালিকানাহীন, সর্বজনভোগ্য ছিল, কী ভাবে তার উপরে আরোপিত হয় কোনও এক বিশেষ পক্ষের মালিকানা। সেই মালিকদের রাজনৈতিক চরিত্র কী, তাঁদের হাতে ক্ষমতার ধরনটাই বা কেমন? এই বই তিনটি স্বভাবতই সেই প্রশ্নের উত্তর সন্ধান করেছে। ভারতে ঔপনিবেশিক শাসনের বিস্তারের প্রসঙ্গে রেলপথের ভূমিকার কথা আলোচনা হয় অনেক বেশি। দেবারতি বাগচী এই পরিপ্রেক্ষিতে নদীপথের গুরুত্বের কথা ধরিয়ে দিয়েছেন। নদীর তীরবর্তী অঞ্চল এবং নদী-চরের জমির উপরে খাজনা আদায়ের প্রসঙ্গ থেকেও উঠে এল নদীর মালিকানার প্রশ্ন। নদীর চরের স্বভাব-উর্বর জমি, সেখানে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে চাষের অভিজ্ঞতা কী ভাবে বদলে গেল ঔপনিবেশিক শাসনের হস্তক্ষেপে, তার সংক্ষিপ্ত কিন্তু স্পষ্ট বর্ণনা রয়েছে।
বই তিনটিকে যদি এক সঙ্গে পাঠ করা যায়, তা হলে ফুটে উঠতে পারে অর্থনৈতিক ইতিহাসের একে অপরের সঙ্গে জুড়ে থাকা ধারাটিও। চায়ের বাণিজ্যের জন্য প্রয়োজন হল দ্রুতগামী জল পরিবহণ, তার জন্য বাগ মানানোর চেষ্টা হল বেখেয়ালি ব্রহ্মপুত্র নদীকে। আবার, সেই নদীকে বাষ্পশক্তি দিয়ে বাগ মানানোর ফলেই আরাকানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জিততে পারল ইংরেজরা।
নদীর চলা
দেবারতি বাগচী
চা-বাগানের দুর্দশার কথা প্রসঙ্গে এসেছে বড় ব্যবসায়ীদের অন্যায্য মুনাফা অর্জনের প্রবণতার কথা। বিহার থেকে পশ্চিমবঙ্গ-অসমের চা-বাগানের শ্রমিক হিসাবে নিয়ে আসা হয়েছিল যে মানুষদের, তাঁদের উত্তর-প্রজন্ম কী ভাবে ফের পরিযায়ী শ্রমিক হয়ে উঠছেন, কাজের খোঁজে পাড়ি জমাচ্ছেন বিভিন্ন মহানগরীতে, এসেছে সে কথাও। স্পষ্ট ভাবে বলা নেই, তবে লেখার ভাঁজে ভাঁজে এ কথাও পড়ে নেওয়া যায় যে, এই শ্রমিকদের কথা তেমন ভাবে ভাবেনি সরকারও।
নদীবাঁধের প্রসঙ্গে এসেছে উন্নয়ন-বিধ্বস্ত জনগোষ্ঠীর কথা, বাঁধের জলে যাঁদের সংসার ভেসে গিয়েছে। “দেশের উন্নতির খসড়া তৈরির সময় কে কে বাদ পড়ে লাভের হিসেব থেকে? সেই উন্নতি যদি অনেক মানুষের ক্ষতির বিনিময়ে আসে, তা হলে তা কেনই বা এত জরুরি?”— নদীর কথা বইটির একেবারে শেষ অনুচ্ছেদে মোক্ষম প্রশ্নটি উত্থাপন করেন দেবারতি। তিনি জানেন, বইটির উদ্দিষ্ট পাঠক স্কুলপড়ুয়ারা। এবং, সেই কারণেই এই প্রশ্নগুলো এখনই তোলা প্রয়োজন— ‘উন্নয়ন’ বলতে রাষ্ট্র বা বাজার যা শেখাতে চায়, সেই কথা তাদের মাথায় এবং মনে পাকাপাকি ভাবে বসে যাওয়ার আগেই। যাতে তারা উন্নয়নের সেই ভাষ্যকে পাল্টা প্রশ্ন করতে শেখে। তবে, এই পাল্টা বয়ান শেখানোর কাজটি যেন পক্ষপাতদুষ্ট না হয়।
যুদ্ধের নানা দিক
শান্তনু সেনগুপ্ত
ইনস্টিটিউট অব ডেভলপমেন্ট স্টাডিজ় কলকাতামূল্য অনুল্লিখিত
ইতিহাসের পাঠ কখনও রাজনীতি-বিবর্জিত হতে পারে না। যে কোনও ঘটনাকে, অতীতের যে কোনও মুহূর্তকে আমরা একটি নির্দিষ্ট মূল্যবোধ, নৈতিকতার অবস্থান থেকেই দেখি। স্কুলপাঠ্য ইতিহাস বই এড়িয়ে চলতে চায় রাজনীতির সেই খাত। অথবা, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাধররা সেই দেখার উপরে নিজেদের দর্শন চাপিয়ে দিতে চায়— এখন যেমন কেন্দ্রীয় সরকার বারে বারেই পাল্টে দিচ্ছে পাঠ্যক্রম; নিজেদের পছন্দমতো বাদ দিচ্ছে বা জুড়ে দিচ্ছে পাঠ। তার প্রতিস্পর্ধী জায়গা থেকে উদারবাদী নৈতিক দর্শনের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা ইতিহাস স্কুলপড়ুয়াদের হাতে পৌঁছে দেওয়ার কাজটি এই মুহূর্তে বিশেষ ভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এই গ্রন্থমালা সেই কাজটি করছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy