Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪

উন্নয়নে ধারাবাহিকতার অভাবেই ক্রমশ পিছিয়ে গিয়েছে এই শহর

স্বাধীনতার নয় বছর আগে শ্রীরামপুরের নাগরিক জীবনে এক ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটেছিল। সালটা ১৯৩৮। শ্রীরামপুরে রাস্তায় জ্বলেছিল বৈদ্যুতিক বাতি। তারও আগে কলকাতায় এবং জেলার মধ্যে চন্দননগরেই একমাত্র রাস্তায় গ্যাসের বাতি জ্বলত। আরও একটি ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী একদা দিনেমারদের এই শহর। ১৮৫৪ সালে শ্রীরামপুর ও হাওড়ার মধ্যে ট্রেন চলাচল শুরু হয়।

শ্রীরামপুর কলেজ।—নিজস্ব চিত্র।

শ্রীরামপুর কলেজ।—নিজস্ব চিত্র।

গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায়
শ্রীরামপুর শেষ আপডেট: ১১ নভেম্বর ২০১৪ ০১:১১
Share: Save:

স্বাধীনতার নয় বছর আগে শ্রীরামপুরের নাগরিক জীবনে এক ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটেছিল। সালটা ১৯৩৮। শ্রীরামপুরে রাস্তায় জ্বলেছিল বৈদ্যুতিক বাতি। তারও আগে কলকাতায় এবং জেলার মধ্যে চন্দননগরেই একমাত্র রাস্তায় গ্যাসের বাতি জ্বলত। আরও একটি ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী একদা দিনেমারদের এই শহর। ১৮৫৪ সালে শ্রীরামপুর ও হাওড়ার মধ্যে ট্রেন চলাচল শুরু হয়।

বস্তুত ট্রেন চলাচলের বিষয়টি সেই সময় নাগরিক জীবনে এক যুগান্তকারী ঘটনা। দিনেমার আমলেই প্রতিদিনকার জীবনে নাগরিকদের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য দেখভালের জন্য ১৮০৬ সালে গড়ে উঠেছিল ভিলেজ কমিটি। হালআমলের বেনিফিসিয়ারি কমিটির ধাঁচে। ১৯৬৪ সালে শ্রীরামপুর পুরসভার নির্বাচনে প্রাপ্তবয়স্করা প্রথম ভোটদানের অধিকার পেলেন। পুর পরিষেবার ইতিহাসে যা উল্লেখযোগ্য ঘটনা।

যে শহরের ইতিহাস এত সমৃদ্ধ তার বর্তমান কী সেই দাবি করতে পারে? শহরের সর্বত্রই এখন এই প্রশ্ন। যে শহরে ৭৬ বছর আগে পথে বৈদ্যুতিক বাতি জ্বলেছিল, উন্নয়নের ধারাবাহিকতা কী ধরে রাখতে পেরেছে তার বর্তমান? হাল আমলের প্রশাসকেরা?

এক কথায় উত্তর, না।

গঙ্গাপাড়ের এই প্রাচীন শহরে গঙ্গাটাই সেই অর্থে কাজে লাগানো হল কই? ধূলো আর গা- ঘেঁষাঘেঁষির বর্তমান বাস্তবতায় গঙ্গাই এই শহরের চেহারাটার আমূল বদল আনতে পারত। যে ভাবে চন্দননগর কাজে লাগিয়েছে তার পরিসরকে। বর্তমান রাজ্য সরকার গঙ্গাপাড়কে সাজিয়ে তুলতে যথেষ্ট গুরুত্ব দিচ্ছে। সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে শ্রীরামপুরকে বর্তমান প্রশাসকেরা অন্য চেহারায় হাজির করতেই পারেন। অন্যরকম আলো আর গাছ দিয়ে এই শহরে গঙ্গার পাড়কে আরও প্রসারিত করার চেষ্টা কিন্তু হতেই পারে বলে চিন্তার খোরাক যুগিয়েছেন এই শহরেরই প্রবীণেরা।

আধুনিক নগর সভ্যতার নিরিখে নিকাশি, আলো, পথঘাট, পরিষ্কার-পরিচ্ছনতা, নাগরিক স্বাচ্ছন্দ্য যদি কোনও শহরের উন্নয়নের ছবি হয় তা হলে অবশ্যই এই শহরে সেই ছবির ক্যানভ্যাস অস্পষ্টই থেকে গিয়েছে।

বাসিন্দাদের অভিমত, জনসংখ্যার চাপে শহর জর্জরিত। শহরের ঐতিহ্যবাহী স্মারক হারিয়ে যাচ্ছে। তাৎক্ষনিক উন্নয়নের ঝোঁকে অতীত নিয়ে উদাসীন সমাজ। শহরের গর্ব করার মতো বহু স্মৃতি শেষ। শহরের মানুষ সাবলীলভাবে আকাশ দেখতে পান না। প্রতিদিন সেই দেখার পথ চুরি হয়ে যাচ্ছে। প্রমোটাররাই এখন ঐতিহাসিক এই শহরের শেষ কথা। যে আক্ষেপ এখন বহু প্রবীণের গলায়। শহরের অতীতের স্মারক নিয়ে তৈরি হতে পারত একটি আস্ত মিউজিয়াম।

শহর অল্প বৃষ্টিতে জল জমে। স্টেশন চত্বর তার ব্যতিক্রম নয়। শহরের নিকাশী ব্যবস্থা অত্যন্ত খারাপ। শহরের পুরোন নিকাশী খালই চুরি হয়ে গিয়েছে। তা দখল হয়ে পুর কর্তাদের নাকের ডগাতেই সেখানে বসতি হয়েছে। অপরিসর রাস্তায় বাস, অটো, রিক্সার দাপাদাপিতে নাকাবন্দি শহর গতি হারিয়েছে। সবুজ কমছে। খেলার মাঠ চুরি হচ্ছে। শহরের প্রবীণ আর শিশুদের নিঃশ্বাস নেওয়ার জায়গা ছোট হচ্ছে।

এরজন্য প্রমোটাররাজকে দায়ী করা হচ্ছে। কিন্তু এর উল্টো বাস্তবতাও এখন হাজির। শহরের পুরোন বাড়ি ভেঙে আকাশচুম্বি ফ্ল্যাট হচ্ছে। শহরে এখন ঠাঁই পাওয়া, আবাসন জলন্ত সমস্যা। যৌথ পরিবার ভেঙে টুকরো হচ্ছে। মানুষ শহরমুখী। বাড়ছে মাথা গোঁজার জায়গার চাহিদা। এই চাহিদার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে নানা রঙের, নানা দামের হরেক কিসিমের ফ্ল্যাট হাজির। সরকারি, বেসরকারি ব্যাঙ্কগুলি গ্রহকদের ঋণ দিতে তৈরি। বিক্রি হয়ে যাচ্ছে ফ্ল্যাট।

জনসংখ্যার পাশাপাশি পাল্লা দিয়ে বাড়ছে অপরাধ। বাইরের বহু ভাষাভাষীর মানুষ আশায় শহরে অপরাধের ধরন বদলে গিয়েছে। তার সঙ্গে সামাল দিতে হিমশিম পরিকাঠামোহীন পুলিশ। এমন অভিমত শহরের বাসিন্দা পুরোন পুলিশ কর্তাদের।

শ্রীরামপুরের বিশিষ্ট চিকিৎসক অসিত দত্ত বলেন,“বদল অনিবার্য। তবে শ্রীরামপুর আগে বসবাসের পক্ষে অনেক ভাল ছিল। রাস্তাঘাট পরিস্কার ছিল। অনেক বেশি সবুজ ছিল আগে। পাখি আর পুকুরও অনেক বেশি ছিল। চোখের সামনেই অনেক পুকুর বুজে গেল। আকাশ চুরি হয়ে যাচ্ছে। আগে আমার বাড়ি থেকেই সূর্যদয় দেখা যেত। কিন্তু এখন সাতটার আগে সূর্যের আলো চোখে পড়ে না। আবাসনের দৌলতে। তবে আমরা চেষ্টা চালাচ্ছি। মানুষকে সচেতন করার কাজ করছি।”

শ্রীরামপুরে রামমোহন রায়ের মামার বাড়ি। দেশগুরু ভট্টাচার্যের এখনকার প্রজন্মের মানুষ পিনাকী ভট্টাচার্য। তিনি বলেন,“ধর্মীয় এবং পড়াশোনার নিরিখে এখন শ্রীরামপুর অনেকটাই এগিয়েছে। টেক্সস্টাইল আর মহিলাদের কলেজ। একেবারে ইতিহাসের সময়ের থেকে হাসপাতাল দুটি হয়েছে পরবর্তী সময়ে। যদিও বা তার মান নিয়ে প্রশ্ন আছে।” তাঁর সংযোজন,“নগরায়নের আধুনিকতার ক্ষেত্রে শহরে খামতি রয়ে গিয়েছে যথেষ্ট। একটিমাত্র ফ্লাইওভার। শহরের সুয়ারেজ পরিকাঠামোর কাজও অসমাপ্ত। রাস্তা অপরিসর, সবুজ অনেকটাই কমেছে। মাল্টিস্টোরিড বাড়ি বেড়েছে। ইতিহাস রক্ষণে আরও যন্তের ছাপ আশা করা গিয়েছিল।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE