Advertisement
০৭ মে ২০২৪
উত্তরপাড়া

জমি বাড়ন্ত, ফ্ল্যাটের জন্য হাত পুরনো বাড়িতেই

জমি বাড়ন্ত। কিন্তু নগরায়নের ধাক্কা সামলানো সহজ নয়। এখন পুরনো বাড়ি ভাঙার প্রবণতা গোটা উত্তরপাড়া জুড়ে। বস্তুত, আবাসনের ধাক্কায় হারিয়ে গিয়েছে শহরের রাজবাড়িটাই। রাজকৃষ্ণ স্ট্রিটে সেই রাজবাড়ির জায়গায় এখন কয়েক হাজার বর্গফুট জুড়ে মাথা তুলেছে চারতলা আবাসন। সেখানে নামটাই যা রয়ে গিয়েছে, ‘রাজবাড়ি’। আর রয়েছে লাগোয়া বড় ফাঁকা মাঠ। সেই মাঠটাও এখন বিক্রির চেষ্ট চলছে। বাকিটা অতীত।

গঙ্গার পাড় ঘেঁষে গড়ে ওঠা একের পর এক আবাসন। উঠেছে আইন ভাঙার অভিযোগ ।

গঙ্গার পাড় ঘেঁষে গড়ে ওঠা একের পর এক আবাসন। উঠেছে আইন ভাঙার অভিযোগ ।

গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২৫ নভেম্বর ২০১৪ ০১:১৯
Share: Save:

জমি বাড়ন্ত।

কিন্তু নগরায়নের ধাক্কা সামলানো সহজ নয়। এখন পুরনো বাড়ি ভাঙার প্রবণতা গোটা উত্তরপাড়া জুড়ে।

বস্তুত, আবাসনের ধাক্কায় হারিয়ে গিয়েছে শহরের রাজবাড়িটাই। রাজকৃষ্ণ স্ট্রিটে সেই রাজবাড়ির জায়গায় এখন কয়েক হাজার বর্গফুট জুড়ে মাথা তুলেছে চারতলা আবাসন। সেখানে নামটাই যা রয়ে গিয়েছে, ‘রাজবাড়ি’। আর রয়েছে লাগোয়া বড় ফাঁকা মাঠ। সেই মাঠটাও এখন বিক্রির চেষ্ট চলছে। বাকিটা অতীত।

অথচ, কয়েক দশক আগেও রাজবাড়িটি শুধু উত্তরপাড়ার নয়, জেলার বিস্তৃত অংশের মানুষের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু ছিল। তার পোশাকি নাম ছিল ‘ঘড়িবাড়ি’। শহরের ইতিহাস নিয়ে চর্চা করছেন, এমন কয়েক জন জানান, উনিশ শতকের গোড়ার দিকে উত্তরপাড়ার জমিদার ছিলেন নন্দগোপাল মুখোপাধ্যায়। তাঁর ছেলে ছিলেন জগমোহন। জগমোহনের দুই ছেলে জয়কৃষ্ণ এবং রাজকৃষ্ণ। রাজকৃষ্ণের ছেলে হরিহরের উদ্যোগেই সেই আমলে অন্তত ১০ লক্ষ টাকায় প্রাসাদোপম বাড়িটি তৈরি হয়েছিল প্রায় এক দশক ধরে।

কেমন ছিল সেই রাজবাড়ি?

যাঁরা শহরের ইতিহাস নিয়ে চর্চা করেন, তাঁরা জানান, প্রবেশ-দ্বারের মাথায় ছিল শ্বেতপাথরের দু’টি সিংহ। তিনমহলা প্রাসাদের সামনে ছিল ন’টি থাম। তারও সামনের দিকে ছিল দু’টি গম্বুজ। তার একটিতে টাওয়ার ক্লক বা ‘শীর্ষঘড়ি’। ওই ঘড়িটির জন্যই বাড়িটির নাম হয়ে দাঁড়ায় ‘ঘড়িবাড়ি’। সেই ঘড়ির আওয়াজ লাগোয়া বালি-বেলুড় পর্যন্ত শোনা যেত। সেই ঘড়ি নিয়েও তখনকার দিনে নানা গল্প মুখে মুখে ফিরত। কেউ বলতেন ঘড়িটি হ্যামিল্টনের দোকান থেকে সাড়ে চার হাজার টাকায় কেনা হয়েছিল। আবার কেউ বলতেন, সেটি সরাসরি লন্ডনেরই বিগ বেন থেকে জাহাজে চাপিয়ে পাঠানো হয়েছিল। মুর্শিদাবাদের হাজারদুয়ারির মতোই রাজবাড়িতে ছিল অসংখ্য নকল দরজা। মেঝে ছিল ইতালিয়ান মার্বেলের। দেওয়ালে ছিল বেলজিয়ান গ্লাসের আয়না। প্রাসাদের অন্যতম আকর্ষণ ছিল নাচঘর। সেই নাচঘরের চারদিকে ছিল গ্যালারি। অনেকটা বারান্দার মতো। সেই গ্যালারিতে বসেই বাড়ির মহিলারা নাচ দেখতেন।

পুরোটাই এখন ইতিহাস। শহরের ইতিহাস নিয়ে দীর্ঘদিন চর্চা করছেন প্রবীণ রথীন চট্টোপাধ্যায়। তাঁর আক্ষেপ, “ঘড়িবাড়িকে প্রোমোটারের হাত থেকে বাঁচাতে না পারার জন্য আজও নিজেকে অপরাধী মনে হয়। অনেক চেষ্টা করেছিলাম। এক রকম হেরেই গেলাম।”

ঘড়িবাড়ি ভেঙে আবাসন তৈরি হয়েছে অন্তত তিন দশক আগে। নেতাজির স্মৃতি জড়িত প্রাচীন পুরভবনটাই ভেঙে ফেলা হয়েছে। ওই বাড়িটি ঘিরে অনেক পরিকল্পনার কথা বলা হলেও তা বাস্তবে আদৌ হয়নি। তার পরে আরও কত যে পুরনো বাড়ি ভাঙা পড়েছে, তার কোনও হিসাব পুরসভার কাছে নেই। এক প্রবীণের ক্ষোভ, “উত্তরপাড়া, ভদ্রকালীর কোনও গলিতে দু’সপ্তাহ পরে গেলে নিশ্চিত ভাবে দেখা যাবে, অন্তত একটি বাড়ি ভাঙা শুরু হয়েছে। পুরসভা কি কিছুই দেখবে না?”

বস্তুত, কাঠাপ্রতি দশ লক্ষ টাকা ফেললেও এ শহরে এখন আর মনের মতো জমি মেলে না। কলকাতার গা ঘেঁষা হুগলির এই শহর থেকে পা বাড়ালেই হাওড়া-বর্ধমান মেন ও কর্ড এবং শিয়ালদহ শাখায় যাওয়ার ট্রেন মেলে। দ্রুত দমদম এয়ারপোর্ট যাওয়ার জন্য তৈরি হয়েছে বেলঘরিয়া এক্সপ্রেসওয়ে। বালি ব্রিজের যানজট কমাতে রয়েছে নিবেদিতা সেতু। অদূরে দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে। সব মিলিয়ে যোগাযোগ ব্যবস্থা যত সহজ হয়েছে, তত শহর ভরেছে আবাসনে। এমনকী, গঙ্গার পাড়ের জমি দখল করেও ফ্ল্যাট নির্মাণ হচ্ছে এবং তাতে নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা করা হচ্ছে না বলে অভিযোগ। ভদ্রকালী, মধ্য-ভদ্রকালী, কোতরং বা রেললাইনের পশ্চিম প্রান্তে মাখলায় রাস্তার ধারে সস্তায় মনপসন্দ জমি এক দশক আগেও মিলত। কেউই তাঁদের জমি কেনার আগ্রহের প্রথম তালিকায় রাখতেন না ওইসব এলাকাকে। কিন্তু এখন ওই সব জায়গাতেও জমি বাড়ন্ত। ফলে পুরনো বাড়ি ভেঙে ফেলাই নতুন বাড়ি তোলার সহজ উপায়।

রাজকৃষ্ণ স্ট্রিটের রাজবাড়ি ভেঙে তৈরি বহুতল।

উদাসীনতার অভিযোগ মানেননি উত্তরপাড়া-কোতরং পুরসভার কর্তারা। পুরসভার চেয়ারপার্সন অদিতি কুণ্ডুর দাবি, “প্রয়োজনমতো আমরা পুরনো বাড়ি ভাঙা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করি। রাজবাড়িটি ভাঙা পড়েছিল বাম আমলে। আমাদের কিছু করার ছিল না। আর মানুষ যদি ব্যক্তিগত কারণে বসতবাড়ি বিক্রি করেন, সে ক্ষেত্রে পুরসভা কী ভাবে নিয়ন্ত্রণ করবে?”

পুরনো বাড়ি ভাঙা নিয়ে আফশোস তো রয়েছেই, তার আগে কয়েক দশক ধরে যে ভাবে পুকুর বুজিয়ে এ শহরে আবাসন হয়েছে, তা ভুলতে পারেন না পরিবেশ-কর্মীরা। এখনও মাঝেমধ্যে পুকুর বোজানো হয়। তাতে শহরের পরিবেশের ভারসাম্যও নষ্ট হয়েছে বলে তাঁদের দাবি। দীর্ঘদিন ধরে শহরের পুকুর বাঁচানোর চেষ্টা করছেন শশাঙ্ক কর। তাঁর কথায়, “পুকুরের মালিকেরা অনেকেই প্রথমে পুকুরটি জঞ্জালে ভরে ফেলছেন। তার পরে ধীরে ধীরে বুজিয়ে তা তুলে দিচ্ছেন প্রোমোটারের হাতে। পুর কর্তৃপক্ষ সব জেনেও কিছু করছেন না।” পরিবেশ-বন্ধু বিশ্বজিৎ মুখোপাধ্যায়ের দাবি, “পুকুর বোজানো নিয়ে কেউ যদি কোনও অভিযোগ না-ও করেন, তা হলেও পুর কর্তৃপক্ষ বা কাউন্সিলরই ব্যবস্থা নিতে পারেন। কারা পুকুর বোজাচ্ছেন, তাঁদের চিহ্নিত করে থানায় এফআইআর করতে পারেন। মৎস্য দফতরকে বিষয়টি জানাতে হবে। পুর কর্তৃপক্ষ দায় এড়াতে পারেন না।”

পুরসভার দাবি, অনেক ক্ষেত্রেই পুকুর বোজানো হলে তার মালিককে বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। পুরসভা স্বতঃপ্রণেদিত হয়ে বেশ কিছু পুকুরের জঞ্জাল সরিয়েছে। তবে, পুরসভার চেয়ারপার্সন মেনে নিয়েছেন, “পুরসভার ভূমিকায় অনেক পুকুর-মালিক আপত্তি জানিয়ে আদালতে মামলা করছেন। তাই আইনি ফাঁসে না জড়ানোর জন্য অনেক ক্ষেত্রে পুরসভাকে পিছিয়ে আসতে হচ্ছে।”

১৮৫৩ সালে জমিদার জয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়ের উদ্যোগে তৈরি হয়েছিল উত্তরপাড়া পুরসভা। সেই সময়ে পুর কর্তৃপক্ষ নাগরিকদের যে ভাবে পরিষেবা দিত, তা বিদেশি শাসকদেরও প্রশাংসা কুড়িয়ে ছিল। বর্তমানে লোকের ভারে জর্জরিত হওয়ার জন্যই কি পুরসভা সব দিকে চোখ রাখতে পারছে না? প্রশ্নটা তুলছেন বাসিন্দারা। পুরসভা তা মানছে না।

“প্রয়োজনমতো আমরা পুরনো বাড়ি ভাঙা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করি।
মানুষ যদি ব্যক্তিগত কারণে বসতবাড়ি বিক্রি করেন,
সে ক্ষেত্রে পুরসভা কী ভাবে নিয়ন্ত্রণ করবে?”

অদিতি কুণ্ডু, পুরপ্রধান

(চলবে)

ছবি: দীপঙ্কর দে।

কেমন লাগছে আমার শহর?
আপনার নিজের শহর নিয়ে আরও কিছু বলার থাকলে আমাদের জানান।
ই-মেল পাঠান district@abp.in-এ। Subject-এ লিখুন ‘আমার শহর উত্তরপাড়া’।
অথবা চিঠি পাঠান, ‘আমার শহর’, হাওড়া ও হুগলি বিভাগ, জেলা দফতর,
আনন্দবাজার পত্রিকা, ৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা- ৭০০০০১

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE