Advertisement
১১ মে ২০২৪
উত্তরপাড়া

নষ্ট হচ্ছে বহুমূল্য বই, সমস্যার ভারে ন্যুব্জ জয়কৃষ্ণ পাঠাগার

এক সময়ে উত্তরপাড়া জয়কৃষ্ণ পাঠাগারের সংগ্রহ দেখে মুগ্ধ হয়ে দীনবন্ধু মিত্র লাইন ক’টি লিখেছিলেন। আর এখন সংরক্ষণের অভাবে নষ্ট হতে বসেছে পাঠাগারের অমূল্য সম্পদ। নানা সমস্যার ভারে দিন দিন নুয়ে পড়ছে বাঙালির অন্যতম গর্বের এই প্রতিষ্ঠানটি। সবচেয়ে বড় সমস্যা কর্মীর অভাব। নেই নিরাপত্তা রক্ষীও। কেননা, নতুন নিয়োগ হচ্ছে না।

বহু ইতিহাসের সাক্ষী জয়কৃষ্ণ পাঠাগার। ছবি: দীপঙ্কর দে।

বহু ইতিহাসের সাক্ষী জয়কৃষ্ণ পাঠাগার। ছবি: দীপঙ্কর দে।

গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২৬ নভেম্বর ২০১৪ ০১:০৪
Share: Save:

বীণাপাণি মনোরম পুস্তক আলয়

শতশত শাস্ত্রমালা যথায় সঞ্চয়...

এক সময়ে উত্তরপাড়া জয়কৃষ্ণ পাঠাগারের সংগ্রহ দেখে মুগ্ধ হয়ে দীনবন্ধু মিত্র লাইন ক’টি লিখেছিলেন।

আর এখন সংরক্ষণের অভাবে নষ্ট হতে বসেছে পাঠাগারের অমূল্য সম্পদ।

নানা সমস্যার ভারে দিন দিন নুয়ে পড়ছে বাঙালির অন্যতম গর্বের এই প্রতিষ্ঠানটি। সবচেয়ে বড় সমস্যা কর্মীর অভাব। নেই নিরাপত্তা রক্ষীও। কেননা, নতুন নিয়োগ হচ্ছে না। কর্মীরাই জানাচ্ছেন, অর্থাভাবে পুরনো বইয়ের সংরক্ষণের কাজও প্রায় বন্ধ। অথচ, এখনই বহু বই এবং পুঁথি যথাযথ ভাবে সংরক্ষণ করা না হলে চিরতরে নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

জি টি রোডের গা-ঘেঁষে চওড়া লোহার গেট পেরিয়ে একটু এগোলেই প্রাসাদোপম ভবনটা অবশ্য এখনও ঝকঝকে। বেশ কয়েকটা চওড়া সিঁড়ি পেরিয়ে বিশাল ছ’টি থাম। মধ্যিখানে পাঠাগারের প্রতিষ্ঠাতা, উত্তরপাড়ার জমিদার জয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়ের মূর্তি। যেন এখনও তিনি বাংলা সংস্কৃতির ইতিহাসকে আগলে রয়েছেন! ভিতরে নীচের তলায় গ্রন্থাগারিকের ঘর। উপরে সুদৃশ্য ব্যালকনি। মাথায় কাঠের ছাউনি। দোতলায় সেমিনার হল। কাঠের সিঁড়ি পেরিয়ে সেই হলে পৌঁছতে হয়। পাঠাগারের বাইরের গোলাকার থাম স্থাপত্যরীতির দিক দিয়ে অত্যন্ত সমৃদ্ধ। স্তম্ভের একেবারে উপরের দিকে পদ্মের পাপড়ি। ইউরোপের ধ্রুপদী স্থাপত্য-রীতিকে মনে করিয়ে দেয় এই গ্রন্থাগারের নির্মাণ। গঙ্গা এই শতাব্দী-প্রাচীন স্থাপত্যকে এক অন্য মাত্রা দিয়েছে।

বর্তমানে পাঠাগারে বইয়ের সংখ্যা প্রায় ২ লক্ষ। তার মধ্যে ৫৫ হাজার বই অত্যন্ত দুর্লভ, যা অবিলম্বে সংরক্ষণের প্রয়োজন বলে দাবি কর্মীদের। “দুঃখ হয় জানেন। আমি যখন দায়িত্বে ছিলাম তখন এই পাঠাগারকে ‘ইনস্টিটিউট অব ন্যাশনাল ইমপর্টেন্স’ হিসেবে ঘোষণার জন্য রাজ্য সরকারের কাছে আবেদন করেছিলাম। কিন্তু সাড়া পাইনি। কর্মিসংখ্যা তলানিতে ঠেকেছে। সরকারের হুঁশ নেই” আক্ষেপ গত বছর গ্রন্থাগারিকের পদ থেকে অবসর নেওয়া স্বাগতা দাস মুখোপাধ্যায়ের।

পাঠাগারটির সংরক্ষণ নিয়ে কী ভাবছে সরকার?

রাজ্যের গ্রন্থাগার মন্ত্রী আব্দুল করিম চৌধুরী বলেন, “ওই পাঠাগারকে ‘ইনস্টিটিউট অব ন্যাশনাল ইমপর্টেন্স’ হিসেবে ঘোষণার জন্য কেন্দ্রের কাছে সুপারিশ করা হয়েছে। ওখানে নিয়োগ বা বই সংরক্ষণের সমস্যা মেটানোর প্রক্রিয়া জারি রয়েছে। নিরাপত্তা রক্ষীর জন্য টেন্ডার হয়ে গিয়েছে।”

ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে এই পাঠাগারের গুরুত্ব কম নয়। ১৮৫৯ সালে চালু হয়েছিল পাঠাগারটি। প্রচুর পত্রপত্রিকা এবং বই নিজের চেষ্টায় জয়কৃষ্ণ পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে আনিয়ে ছিলেন। ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠানটি হয়ে ওঠে সংস্কৃতি চর্চার কেন্দ্রবিন্দু।

কে আসেননি এই পাঠাগারে?

রেভারেন্ড লং, উইলিয়াম হান্টার, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগার, মেরি কার্পেন্টার, ভূদেব মুখোপাধ্যায়, দীনবন্ধু মিত্র, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়... আরও কত দিকপাল!

একতলার সব ঘরেই রয়েছে বই। দোতলা তৈরি হয়েছিল মূলত বহিরাগত পণ্ডিত-গবেষকদের সাময়িক বসবাস করে গবেষণার কাজ এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য। জয়কৃষ্ণের আমন্ত্রণে মাইকেল মধুসূদন দু’বার এই গ্রন্থাগারে অতিথি হয়ে ছিলেন। প্রথমবার তিনি যখন আইনজীবী হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেতে শুরু করেছেন। আর দ্বিতীয়বার অসুস্থ অবস্থায়। একই ভাবে জমিদারের আমন্ত্রণে এসেছিলেন ব্রিটিশ গবেষক উইলিয়ম হান্টারও। জয়কৃষ্ণের মৃত্যুর পরে তাঁর ছেলে রাজা প্যারীমোহন মুখোপাধ্যায়েরও আতিথ্য পেয়েছেন হান্টার। ইতিহাস প্রসিদ্ধ এই পাঠাগারের কথা সেকালের পত্র-পত্রিকায় বারেবারেই বিষয় হয়ে উঠে এসেছে। ‘সম্বাদ ভাস্করে’ (২৭ জানুয়ারি ১৮৫৭) পাঠাগার নির্মাণের খবর স্থান পেয়েছিল।

গবেষকেরা অবশ্য এখনও পাঠাগারে আসেন। আসেন স্থানীয় মানুষেরা। পাঠাগারটি দেখভালের জন্য সরকার অনুমোদিত পদ রয়েছে ২২টি। কিন্তু বর্তমানে রয়েছেন ১২ জন। স্বাগতাদেবীর অবসর নেওয়ার পরে নতুন গ্রন্থাগারিকও নিয়োগ হয়নি। ফলে, পাঠকদের চাহিদা এবং প্রশাসনিক কাজকর্ম সামাল দিতে গিয়ে স্বল্পসংখ্যক কর্মী নাজেহাল হচ্ছেন।

পাঠকদের ক্ষোভ, যে ভাবে রবিবার ছাড়াও প্রতি মাসের প্রথম এবং চতুর্থ শনিবার পাঠাগার বন্ধ রাখা হচ্ছে, তাতে পঠনপাঠনের সুযোগ থেকে অনেকেই বঞ্চিত হচ্ছেন। কেউ কেউ মনে করেন, সারা সপ্তাহ অফিস করার পর চাকরিজীবীদের হাতে মাত্র একদিন সময় থাকে পাঠাগারের বই পাল্টানো বা সেখানে পড়াশোনার। তা পর্যাপ্ত নয়। ছোটদের নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রেও একই সমস্যা হয়।

এই পাঠাগারের এক সময় নিয়মিত পাঠক ছিলেন উত্তরপাড়ার ভদ্রকালীর এক প্রৌঢ়। তিনি বলেন, “একদিকে গ্রন্থাগারের সময়সীমা আর অন্যদিকে চাহিদা অনুযায়ী বই দেওয়ার ক্ষেত্রে নানা নিয়ম, তাই এখন আর যাওয়া হয় না।” আর এক পাঠকের কথায়, “বলা হচ্ছে শিশুদের বই পড়ার অভ্যাস চলে যাচ্ছে। কিন্তু তাদের জন্য পাঠাগারে সময়সীমা মাত্র দু’ঘণ্টা। তা হলে তাঁদের বই পড়ার অভ্যাস তৈরি হবে কী করে?”

পাঠকদের ক্ষোভের কথা ঠারেঠোরে মেনেও নিয়েছেন বর্তমানে গ্রন্থাগার পরিচালনার কাজে যুক্ত এক পদস্থ আধিকারিক। তিনি বলেন, “বাচ্চাদের বিভাগ খুলে রাখতেও কর্মী প্রয়োজন। গ্রন্থাগারের সার্বিক কাজের ক্ষেত্রেই কর্মীর অভাব থাকায় আমাদের কাজের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা থেকে যাচ্ছে।”

প্রজাবৎসল জয়কৃষ্ণ জীবনের শেষ কুড়ি বছর দৃষ্টিহীন হয়ে কাটিয়েছিলেন। কিন্তু পাঠাগারের কাজে সেই প্রতিবন্ধকতার প্রভাব পড়েনি। পাঠকেরা চান, অতীতের সেই সুদিন ফিরে আসুক।

(চলবে)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE