Advertisement
১০ মে ২০২৪

সুদেব আর নেই, হাহাকার মহল্লায়

সোমবার সকাল থেকে ছিল শুধু হাহাকার। মোড়ে মোড়ে জটলা। রাত নামতেই হঠাৎই সব নিঃশব্দ। ময়না-তদন্তের পরে ৮টা নাগাদ পাড়ার সুদেব দাসের দেহ এলাকায় ঢুকতেই মহিলা-পুরুষ-শিশু-বৃদ্ধ নেমে এলেন রাস্তায়। মৃতদেহ নিয়ে এগোল গাড়ি। পিছনে বিশাল ভিড়। আপদে-বিপদে আর পাশে পাওয়া যাবে না তরতাজা পরোপকারী ছেলেটিকে। তাই যেন শেষ বারের দেখা!

পুলিশি হেফাজতে সুদেব খুনে ধৃত তিন অভিযুক্ত।

পুলিশি হেফাজতে সুদেব খুনে ধৃত তিন অভিযুক্ত।

তাপস ঘোষ
চুঁচুড়া শেষ আপডেট: ০৯ ডিসেম্বর ২০১৪ ০১:৪১
Share: Save:

সোমবার সকাল থেকে ছিল শুধু হাহাকার। মোড়ে মোড়ে জটলা।

রাত নামতেই হঠাৎই সব নিঃশব্দ। ময়না-তদন্তের পরে ৮টা নাগাদ পাড়ার সুদেব দাসের দেহ এলাকায় ঢুকতেই মহিলা-পুরুষ-শিশু-বৃদ্ধ নেমে এলেন রাস্তায়। মৃতদেহ নিয়ে এগোল গাড়ি। পিছনে বিশাল ভিড়। আপদে-বিপদে আর পাশে পাওয়া যাবে না তরতাজা পরোপকারী ছেলেটিকে। তাই যেন শেষ বারের দেখা!

রবিবার রাতে পড়শি ‘কাকু’কে মারধরের হাত থেকে বাঁচাতে গিয়ে দুষ্কৃতীদের গুলিতে খুন হয় চুঁচুড়ার পীরতলার বড়ুয়াবাগান এলাকার উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী সুদেব। সকলের প্রিয় ছেলেটির এই ভাবে মৃত্যু মানতে পারছেন না কেউই। সোমবার সকালে তাই সুদেবদের বাড়ির সামনে সকলে ভিড় করেন। নানা জন সুদেবের কাছ থেকে পাওয়া নানা সাহায্যের কথা বলছিলেন। টেস্ট পরীক্ষার পরে ছেলেটা পড়াশোনা নিয়েই ছিল। কিন্তু বাবার শারীরিক সমস্যার জন্য সংসার সামাল দিতে ছোটখাটো কাজ করছিল। রবিবার বাঁশবেড়িয়ায় গিয়েছিল বিয়েবাড়িতে ফুলের সাজসজ্জা করতে। সেখান থেকে ফেরার সময়েই তার বেঘোরে প্রাণ গেল। ৬২ বছর ধরে ওই এলাকায় বাস করছেন প্রাণকৃষ্ণ দেবনাথ। সুদেবের মৃত্যুর কথা জানার পরে আর নিজেকে ঠিক রাখতে পারেননি। বলেন, “ও আমাকে জেঠু ডাকত। একটা পারিবারিক বিবাদের ফলে তরতাজা নিরীহ ছেলেটা খুন হল। এতে আমরা মর্মাহত।” সুদেবের অযাচিত ভাবে সাহায্যের কথা বলতে গিয়ে তিনি জানান, মাস কয়েক আগে বিদ্যুতের বিল জমা দেওয়ার জন্য তিনি বাড়ি থেকে বেরোতেই সুদেবের সঙ্গে দেখা। সুদেব তাঁর কাছে জানতে চায়, তিনি কোথায় যাচ্ছেন? প্রাণকৃষ্ণবাবুর কথায়, “ওকে যখনই বললাম বিল জমা দিতে যাচ্ছি, ও বলল তোমাকে যেতে হবে না। আমি দিয়ে আসব। আজকাল এমন সাহায্য কে করে?”

গৃহবধূ পুতুল দত্তের স্বামীর মোবাইল রিচার্জের দোকান রয়েছে ওই এলাকায়। তা ছাড়া, বইখাতাও বিক্রি হয়। পুতুলদেবীই বেশির ভাগ সময়ে দোকানে বসেন। অনেক সময়েই সুদেব সেই দোকানের কাজেও সাহায্য করত বলে জানান পুতুলদেবী। সেই ছেলেকে আর দেখতে পাবেন না, বলতে গিয়ে তিনি কেঁদেই ফেলেন। পুতুলদেবীর কথায়, “ছেলেটা এত ভাল ছিল, দোকানে এলে পড়াশোনার আলোচনা করত। আমাদের ভাল লাগত। দোকানের নানা কাজে সাহায্য করত। কোনও জিনিস প্রয়োজন হলে হাসিমুখে এনে দিত। ওর মৃত্যুতে এলাকার অনেক ক্ষতি হল।”

শনিবার রাতে যে ভাবে সুদেবের পড়শির বাড়িতে হামলা হয়, যে ভাবে পড়শিকে বাঁচাতে গিয়ে সুদেব খুন হয়, তা ভাবতে গিয়ে সোমবার শিউরে উঠছিলেন এলাকারই বাসিন্দা তপন চট্টোপাধ্যায়। বছর দশেক ওই পাড়ায় বসবাস করছেন। তাঁর কথায়, “অনেক রাজনৈতিক গোলমাল দেখেছি। কিন্তু এই ধরনের ঘটনা! আমার খুব কষ্ট হয়েছে। সুদেব আপদে-বিপদে পাশে দাঁড়াত। কোনও কাজে কখনও না বলত না। এক বার আমাকে নিয়ে হাসপাতালেও গিয়েছিল। কিন্তু ওর খুন হওয়ার পরে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি।” অবশ্য শুধু পাড়া-পড়শিরাই নন, যে স্কুল থেকে সুদেবের এ বার উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়ার কথা ছিল, সেই মল্লিকবাটি পাঠশালা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সুখেন্দু পালও ছাত্রের মৃত্যুতে মর্মাহত। বলেন, “এখন স্কুলে পরীক্ষা চলছে। তাই ওর বাড়িতে যেতে পারিনি। মঙ্গলবার যাব। ওর পরিবারকে সমবেদনা জানাবার ভাষা জানা নেই। ছেলেটা শুধু পড়াশোনায় ভাল ছিল না, খুব পরোপকারীও ছিল। স্কুলের সরস্বতী পুজোয় সক্রিয় থাকত। সকলের প্রিয় ছিল।” একই ভাবে ভেঙে পড়ে সুদেবের সহপাঠী সমদীপ সরকার এবং রোহন জায়সবালও। দু’জনেই বলে, “সামনেই পরীক্ষা বলে ও খুব চিন্তিত ছিল। পরীক্ষার পরে নতুন ক্লাসে ভর্তির জন্য টাকা জোগাড় করতে নানা অনুষ্ঠানে ফুল সাজানোর কাজ করছিল ও। ওর মুখে কখনও না শুনিনি। ওর মৃত্যু মানতে পারছি না।” কিশোরের মৃত্যু মানতে পারছেন এই না এলাকার কেউই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE