Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

বার্ন স্ট্যান্ডার্ডে কর্তা পিটিয়ে ফুটেজ লোপাট

মুখ্যমন্ত্রী বলছেন, শিল্প-কারখানায় জঙ্গি আন্দোলন চলবে না। অথচ তাঁর দলের বেশ কিছু ট্রেড ইউনিয়ন নেতা-কর্মী যে নেত্রীর কথায় কর্ণপাত করছেন না, বুধবার তা ফের দেখল রাজ্য। এ দিন হাওড়ার বার্ন স্ট্যান্ডার্ড কারখানার জেনারেল ম্যানেজারকে পিটিয়ে শাসক দলের নেতা-কর্মীরা প্রমাণ করে দিলেন, তাঁরা চলছেন তাঁদের মতোই। এই ঘটনার জেরে অবশ্য রাতেই কারখানার গেটে সাসপেনশন অব ওয়ার্কের নোটিস ঝুলিয়ে দেন কর্তৃপক্ষ। মধ্যরাত থেকে তা কার্যকর হচ্ছে বলেও জানিয়ে দেওয়া হয়।

শান্তনু সরকার

শান্তনু সরকার

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০২:১৯
Share: Save:

মুখ্যমন্ত্রী বলছেন, শিল্প-কারখানায় জঙ্গি আন্দোলন চলবে না। অথচ তাঁর দলের বেশ কিছু ট্রেড ইউনিয়ন নেতা-কর্মী যে নেত্রীর কথায় কর্ণপাত করছেন না, বুধবার তা ফের দেখল রাজ্য। এ দিন হাওড়ার বার্ন স্ট্যান্ডার্ড কারখানার জেনারেল ম্যানেজারকে পিটিয়ে শাসক দলের নেতা-কর্মীরা প্রমাণ করে দিলেন, তাঁরা চলছেন তাঁদের মতোই।

এই ঘটনার জেরে অবশ্য রাতেই কারখানার গেটে সাসপেনশন অব ওয়ার্কের নোটিস ঝুলিয়ে দেন কর্তৃপক্ষ। মধ্যরাত থেকে তা কার্যকর হচ্ছে বলেও জানিয়ে দেওয়া হয়।

গত এক বছরে পশ্চিমবঙ্গে ক্ষুব্ধ শ্রমিকদের হাতে খুন হয়েছেন বেসরকারি শিল্পের দুই কর্তা। বার্ন স্ট্যান্ডার্ড রেল মন্ত্রকের অধীন। এবং সেখানকার জিএম-কে মারধরে প্রত্যক্ষ ভাবে জড়িত থাকার জন্য আঙুল উঠেছে হাওড়া পুরসভার তিন তৃণমূল মেয়র পারিষদের দিকে, যাঁদের সঙ্গে শ্রমিক আন্দোলনের আদৌ সংস্রব নেই। প্রমাণ লোপাট করতে তাঁরা জোর করে সিসিটিভি ফুটেজ মুছিয়ে দেন বলে অভিযোগ।

স্থানীয় তৃণমূল নেতৃত্বের তরফে ঘটনাস্থলে যাওয়ার কথা স্বীকার করা হলেও মারধরের অভিযোগ উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। তাঁদের দাবি, আন্দোলন বানচাল করতেই গল্প ফাঁদা হচ্ছে। কিন্তু কারখানা ও শ্রমিকদের আন্দোলনে পুরসভার লোকজন ঢুকে পড়লেন কেন, তার গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা মেলেনি। বার্ন স্ট্যান্ডার্ড কর্তৃপক্ষ রাতে পুলিশে অভিযোগ দায়ের করেছেন। এখনও কেউ গ্রেফতার হয়নি।

এ দিন ঠিক কী ঘটেছে ওখানে?

কারখানা সূত্রের খবর: লোকসানের কারণে বছর দেড়েক আগে হাওড়া বার্ন স্ট্যান্ডার্ডের ১৭৫ জন অস্থায়ী শ্রমিককে চাকরি থেকে সরানো হয়েছিল। পুনর্বহালের দাবিতে গত ১১ ফেব্রুয়ারি কারখানার গেটের সামনে অনশন শুরু করেছেন কর্মচ্যুতেরা। ৬০ জন করে শ্রমিক রিলে অনশন করছেন। অসুস্থ হয়ে পড়ায় মঙ্গলবার দু’জনকে ভর্তি করা হয় হাসপাতালে। স্থানীয় তৃণমূল নেতৃত্ব ‘মধ্যস্থতা’র কারণ দেখিয়ে আন্দোলনে ঢুকে পড়েন। বিকেলে গিয়ে অনশনকারীদের সঙ্গে কথা বলেন হাওড়ার মেয়র রথীন চক্রবর্তী।

এ দিন সকাল থেকে হাওয়া গরম হতে থাকে। তৃণমূল নেতারা দফায় দফায় কারখানায় ভিড় জমান। বেলা ৩টে নাগাদ হাওড়া পুরসভার তৃণমূল চেয়ারম্যান অরবিন্দ গুহ কারখানায় যান। ছিলেন তৃণমূলের তিন মেয়র পারিষদ শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায়, গৌতম চৌধুরী ও শ্যামল মিত্র। অনশনকারীদের সঙ্গে কথা বলেই তাঁরা কারখানায় ঢোকেন।

বেধে যায় ধুন্ধুমার। প্রত্যক্ষদর্শী-সূত্রের অভিযোগ, তৃণমূল নেতারা জিএম শান্তনু সরকারের ঘরে ঢুকে পড়েন। জিএম-কে গালিগালাজ করা হয়। প্রতিবাদ করায় শান্তনুবাবুকে টানতে টানতে নিয়ে যাওয়া হয় মূল গেটের সামনে। শুরু হয় মার। “কোনও কথা না-শুনেই আমাকে বেধড়ক চড়-ঘুষি মারা হয়। ধাক্কা মেরে কারখানার বাইরে বার করে দিয়ে বলা হয় এলাকা ছেড়ে চলে যেতে,” বলেন শান্তনুবাবু। তাঁর সঙ্গে ছিলেন ডেপুটি ম্যানেজার দেবাশিস ভট্টাচার্য। অভিযোগ, তাঁকেও ধাক্কা মেরে গেটের বাইরে বার করে দেওয়া হয়। দু’জনে চলে আসেন আলিপুরে, সংস্থার সদর দফতরে।

দুই পদাধিকারীকে বাইরের লোকের হাতে হেনস্থা হতে দেখে কারখানার অন্য অফিসারেরা তখন ভয়ে কাঁপছেন। নরেন বন্দ্যোপাধ্যায় নামে এক অফিসারের কথায়, “জিএম-কে যে ভাবে পেটানো হল, ভাবা যায় না! বুঝতে পারছি না, কাল থেকে অফিসে আসা যাবে কি না।”

এ দিন দুপুরে গিয়ে দেখা যায়, কারখানার সামনে বিশাল পুলিশ বাহিনী মোতায়েন। শ্রমিকেরা কাজ ছেড়ে বেরিয়ে এসেছেন। অনশনকারীরা তাঁদের জায়গাতেই বসা। তবে যে সমস্ত পুর-কর্তা ও স্থানীয় তৃণমূল নেতা ঘটনার সময় ছিলেন বলে অভিযোগ, তাঁদের কারও দেখা নেই। ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার সুশান্ত ভট্টাচার্য সকালে হেড অফিস থেকে কারখানায় এসেছিলেন। বলেন, “শুনতে পেলাম, দু’নম্বর গেটে কিছু লোক জিএম-কে মারতে মারতে বার করে দিয়েছে।” কারখানার সিকিওরিটি অফিসার অতনু সরকারের অভিযোগ, “চেঁচামেচিতে বেরিয়ে দেখি, কয়েক জন জিএম’কে মারছে! ওরাই পরে সিসিটিভির মনিটরিং রুমে ঢুকে অপারেটরকে ফুটেজ মুছতে বাধ্য করে।”

একটা আন্দোলন চলছিল। তার মানে, ওখানে পুলিশও মজুত থাকার কথা। তারা কী করছিল? বস্তুত এ দিনের ঘটনায় পুলিশের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন কারখানা-কর্তৃপক্ষের একাংশ। তাঁদের বক্তব্য: হাওড়া পুলিশ কমিশনারেট অফিসের উল্টো দিকেই তাঁদের কারখানা। উপরন্তু কারখানার সামনে পুলিশ মোতায়েন ছিল। তা সত্ত্বেও জিএমের গায়ে হাত পড়ল কী ভাবে, সেটা ওঁদের বোধগম্য হচ্ছে না। হাওড়া পুলিশের ডেপুটি কমিশনার নিশাত পারভেজ বলেছেন, “পুলিশের সামনে মারধর করা হয়েছে, এমন অভিযোগ পাইনি। পুলিশ ছিল বাইরে। ভিতরে কী হয়েছে, জানা সম্ভব নয়।”

ছাঁটাইয়ের প্রতিবাদ হোক, কিংবা পুনবর্হালের দাবিতে অনশন সবই শ্রমিক রাজনীতির অঙ্গ। যে কারণে বার্ন স্ট্যান্ডার্ডে অনশনকারীদের আন্দোলনে সামিল হয়েছেন তৃণমূলের শ্রমিক সংগঠন আইএনটিটিইউসি-র হাওড়া জেলার কার্যকরী সভাপতি গোপাল ভট্টাচার্য। কিন্তু পুরসভার চেয়ারম্যান বা তিন মেয়র পারিষদ ওখানে পা গলালেন কোন যুক্তিতে?

এর স্পষ্ট উত্তর মেলেনি। যদিও হাওড়া জেলা তৃণমূল সভাপতি তথা রাজ্যের মন্ত্রী অরূপ রায়ের দাবি, “সাত দিন কেটে গেলেও অনশনকারীদের ব্যাপারে কারখানা-কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নেননি। তাই পুরসভার ওই নেতাদের আমি-ই নির্দেশ দিয়েছিলাম ওখানে গিয়ে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলতে।” কথা বলতে গিয়ে একেবারে গায়ে হাত?

মারধরের অভিযোগ কিন্তু মানতে চাননি মন্ত্রী। বরং তাঁর পাল্টা অভিযোগ, “সব বানানো গল্প।” অভিযুক্ত মেয়র পারিষদ গৌতম চৌধুরীর বক্তব্য, “আন্দোলন বানচাল করার উদ্দেশ্যে এ সব বলা হচ্ছে।” অনশনে যুক্ত থাকা তৃণমূলের শ্রমিক নেতা গোপালবাবুও বলছেন, “কেউ কাউকে মারেনি। শ্রমিকেরা হয়তো কয়েকটা উত্তপ্ত বাক্য বলেছেন। তার বেশি কিছু নয়।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

barn standard manager shantanu sarkar southbengal
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE