Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪

ছোট পত্রিকার পুজোসংখ্যা নিয়ে মেতে উঠেছেন বসিরহাটের সাহিত্যপ্রেমীরা

নতুন লেখক-লেখিকাদের কাছে সাহিত্যচর্চার আঁতুড়ঘর লিটল ম্যাগাজিনের গুরুত্ব অপরিসীম। তবে বর্তমান সময়ে অর্থনৈতিক সমস্যা এবং বৈদ্যুতিন মাধ্যম এবং মোবাইল-সহ নানা ইলেকট্রনিক্সের রমরমার কারণে বাঙালির সাহিত্য চর্চা কমছে বলে মনে করেন সাহিত্যের সঙ্গে যুক্ত অনেকেই। তারমধ্যেই অবশ্য নিজস্ব ঢঙে লড়াইটা চালিয়ে যাচ্ছে মফস্‌সলের বহু ছোট পত্রিকা।

নির্মল বসু
বসিরহাট শেষ আপডেট: ২১ নভেম্বর ২০১৪ ০১:১৭
Share: Save:

নতুন লেখক-লেখিকাদের কাছে সাহিত্যচর্চার আঁতুড়ঘর লিটল ম্যাগাজিনের গুরুত্ব অপরিসীম। তবে বর্তমান সময়ে অর্থনৈতিক সমস্যা এবং বৈদ্যুতিন মাধ্যম এবং মোবাইল-সহ নানা ইলেকট্রনিক্সের রমরমার কারণে বাঙালির সাহিত্য চর্চা কমছে বলে মনে করেন সাহিত্যের সঙ্গে যুক্ত অনেকেই। তারমধ্যেই অবশ্য নিজস্ব ঢঙে লড়াইটা চালিয়ে যাচ্ছে মফস্‌সলের বহু ছোট পত্রিকা।

গত বিয়াল্লিশ বছর ধরে একটানা ‘বর্ণালী’ পত্রিকাটি প্রকাশ করে সাহসী পদক্ষেপের ছাপ রেখে চলেছেন বসিরহাটের নতুন বাজারের কাছে কবি ভূজঙ্গধর রোডের বাসিন্দা প্রবীর ঘোষ। ২০১৪ সালের পুজো সংখ্যায় ২৪০ পৃষ্ঠার বর্ণালীতে চিঠিপত্র বিভাগ থেকে শুরু করে গল্প, ছড়া, কবিতা, খেলাধুলা, রাজনীতি, কৃষিকথা, ভ্রমণ, নাটক, লোকসংস্কৃতি-সহ বিভিন্ন বিষয়ের উপর শতাধিক লেখা প্রকাশিত হয়েছে। বর্ণালী প্রকাশনার কাজও করে। পুজোসংখ্যার বর্নালীতে প্রকাশিত স্বামী সোমেশ্বরানন্দজীর প্রশ্নোত্তরে সমস্যা-সমাধানের প্রচেষ্টা এবং স্বামীজীর সান্নিধ্যে সোফিয়া বিবি সম্পর্কে তড়িত্‌ বন্দ্যোপাধ্যায় গবেষণামূলক লেখা দু’টি উল্লেখযোগ্য। প্রবীরবাবুর কথায়, “পত্রিকা প্রকাশ করা অনেকটা ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর মতো। তা ছাড়া, ধারাবাহিক ভাবে পত্রিকা প্রকাশের ক্ষেত্রে অনেক বাধা-বিপত্তির পাশাপাশি অর্থের প্রয়োজন। অথচ, মফস্‌সল এলাকায় বিজ্ঞাপন পাওয়া কিংবা নিয়মিত পত্রিকা কিনে পড়ার মানুষ পাওয়া ভার। তা ছাড়া, বর্তমান দিনের ছেলেমেয়েদের বড় অংশ ইলেকট্রনিক্স বিনোদনেই বেশি স্বচ্ছন্দ। এ ভাবে পত্রিকা পড়ার মানুষ দিন দিন কমছে। একই সঙ্গে কমছে লেখালেখির প্রতি আগ্রহী ছেলেমেয়ের সংখ্যা।”

অভাব-অভিযোগ সরিয়ে রেখে সাহিত্যিক এবং শিল্পী পান্নালাল মল্লিককের হাত ধরে একচল্লিশ বছরে পা রাখল ‘স্বদেশ’ পত্রিকা। আঞ্চলিক ইতিহাস ও লোকসংস্কৃতি চর্চার অন্যতম বাংলা মাধ্যম ‘স্বদেশ’ বলে দাবি করে পান্নালালবাবু বলেন, “যত অসুবিধাই হোক, স্বদেশ প্রকাশের দিন থেকে আজ পর্যন্ত কখনও বিজ্ঞাপন নিয়ে পত্রিকা ছাপা হয়নি।” এ বারের স্বদেশ পুজোসংখ্যায় তরুণতপন বিশ্বাসের ‘ফেরা’, ইন্দ্রাণী মল্লিকের ‘ওরা তিনজনে মিলে’, অরুণেশ্বর দাসের ‘একাকিত্ব’, ‘রবীন্দ্রনাথ ও বাউল’ প্রবন্ধ এবং পান্নালাল মল্লিকের ‘স্বাধীনতা’ কবিতাটি পাঠকদের মন কেড়েছে। সাদাকালো মাধ্যমে প্রচ্ছদ ছাপার পরে হাতে রং দিয়ে সেটি রঙিন করে তোলার বৈশিষ্ট্য পান্নালালবাবু এখনও চালিয়ে যাচ্ছেন।

ব্যাসদেব গায়েনের সম্পাদনায় চতুর্থ বর্ষে পা রাখল ‘শাশ্বত আলাপন’। শারদ পত্রিকাটি রীতিমতো যত্ন নিয়ে ছাপা হয়েছে। ঝকঝকে ছাপার পাশাপাশি প্রচ্ছদ পরিকল্পনা বেশ উন্নতমানের। কয়েকজন উদ্যোগী যুবকের পুস্তক বিতরণ থেকে শুরু করে রক্তদান অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে গড়ে ওঠা ‘শাশ্বত আলাপন’ বয়সে নবীন হলেও গল্প, কবিতা কিংবা ভ্রমণ কাহিনী নির্বাচন করে ছাপার ক্ষেত্রে ইতিমধ্যেই প্রবীণদের সমীহ অর্জন করেছে। দলে ঢুকে পড়েছে সমীর মাহাতোর ‘বাংলার হারিয়ে যাওয়া লোকসংস্কৃতি’ থেকে শুরু করে দেবব্রত মণ্ডলের ‘লোকগান বোলান গান’ কিংবা অনিল ঘোষের ‘রামধনুর ফিকে গান’, রাধারমণ মণ্ডলের লেখা ‘ইতিহাসের বাউল আর বাউলের ইতিহাস’, দিব্যজ্যোতি মল্লিকের ‘বাংলা মুদ্রণের ইতিবৃত্ত’-এর মতো লেখা। পত্রিকাটিতে গল্প লিখেছেন প্রচেত গুপ্ত, দেবদাস নন্দী, রণেন রায়, মনিদীপা বিশ্বাসের মতো লেখক-লেখিকারা। অশোক চট্টোপাধ্যয়ের সাতাশ বছর বয়সী ‘সাংস্কৃতিক সমসময়’-এ প্রবন্ধ লিখেছেন বুদ্ধদেব বসু। তাঁর লেখা ‘বাংলার রঙ্গমঞ্চের কথা’ কিংবা উদয় সমীরণ নন্দীর ‘ছাঁচে ঢালা শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তন হোক’ পাঠকদের সমৃদ্ধ করবে। নির্মল নাগের ধারাবাহিক লেখা ‘ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম’, ‘বিবেকানন্দের ভূমিকা’ তথ্যভিত্তিক লেখা জানার পরিধিকে আরও বাড়িয়ে দেয়। কৃষ্ণেন্দ পালিতের ‘অপরাহ্নের ঘোড়া’ এবং তরুণতপন বিশ্বাসের ‘কবির রাস্তা’ও অনুভূতিপ্রবণ পাঠকের নজর কেড়েছে।

বসিরহাটে বিজ্ঞান চর্চার অন্যতম ব্যক্তিত্ব সুভাষচন্দ্র কুণ্ডুর সম্পাদনায় উনিশ বছর ধরে প্রকাশিত হয়ে চলেছে ‘বিজ্ঞান দিশা’। এমনিতেই আধুনিক ছেলেমেয়েদের মধ্যে বিজ্ঞাননির্ভর সাহিত্য নিয়ে চর্চা খুব একটা লক্ষ্য করা যায় না। আঞ্চলিক পত্র-পত্রিকায় সে ভাবে বিজ্ঞান নিয়ে লেখা প্রকাশ কমই হয়। যাঁরা বিজ্ঞানের বিষয় নিয়ে লেখালেখি করতে আগ্রহী, তাদের পথ দেখায় ‘বিজ্ঞান দিশা’। আজীবন বিজ্ঞান চর্চা করে চলা সুভাষবাবুর ইন্সটিটিউট অব ফিজিক্স-এর রজতজয়ন্তী বর্ষে তাঁর ছাত্রছাত্রীরা প্রাঞ্জল ভাষায় বিজ্ঞানের জটিল তত্ত্ব ও তথ্য পত্রিকাটিতে তুলে ধরেছেন। বিশেষ করে অরিত্র বন্দ্যোপাধ্যায়, সহিদুল্লা বারি, তীর্থ মণ্ডল, জয়দীপ মিত্ররা লেখনীর জাদুতে বিজ্ঞানকে সাধারণের কাছে সহজ করে তুলেছেন। পত্রিকার ভিতরে ‘স্মৃতি পটে আঁকা’য় ইন্সটিটিউট অব ফিজিক্সের উদ্বোধনে আসা বসিরহাট হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক অরুণকুমার বসু, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ দাস, নন্দলাল ভট্টাচার্য, সুনীতিভূষণ ভট্টাচার্য, শরদিন্দুমোহন সরকার, কৃষ্ণপ্রসাদ ভট্টাচার্যের ছবি অনবদ্য। এ ছাড়াও, পত্রিকাটিতে আরও যে সব রঙিন দুষ্প্রাপ্য ছবি ছাপা হয়েছে সে জন্য সম্পাদক এবং সহ সম্পাদক ধন্যবাদ প্রাপ্য।

সরোজকুমার মিত্রের একাদশ বর্ষে পড়া ‘কাশফুল’ পত্রিকাটির প্রচ্ছদ ভাবনায় এসেছে শান্তি। সম্প্রতি ঘটে যাওয়া কেদারনাথ এবং কাশ্মীরে প্রাকৃতিক দুর্যোগের পরে প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় গাছ লাগানোর আহ্বান উল্লেখযোগ্য। পরেশ ভট্টাচার্যের লেখা ‘উদ্ভট দর্শন সংহিতা, সূচনা পর্ব’, নীরদপ্রসাদ নাথের ‘তবু রঙ্গে ভরা’ এবং নির্মলকুমার মণ্ডলের ‘কত রূপে হেরি তোমায়’ প্রশংসার দাবি রাখে। কয়েকটি লেখার সঙ্গে ইলাস্ট্রেশন আধুনিকত্বের দাবি রাখে। সুনীল চট্টোপাধ্যায়ের ‘দিশালোক’ এ বার অষ্টাদশ বর্ষে পড়েছে। একচল্লিশটি কবিতা এবং বেশ কয়েকটি গল্প প্রকাশ করে সম্পাদক নবীন এবং প্রবীণ প্রতিভাকে সুযোগ দিয়েছেন। তবে পত্রিকা ছাপার ক্ষেত্রে আরও একটু যত্নবান হলে হয় তো ভাল হত। জয়ন্তী চট্টোপাধ্যায়ের ‘তরঙ্গ প্রবাহ’, শৈলেন কাবাসীর ‘স্মরণ’, মৃন্ময়সমীরণ নন্দীর ‘লেখক বুদ্ধিজীবী’ এবং কাজি মুরশিদুল আরেফিনের কবিতা ‘বুদ্ধিজীবী’ সত্যই সুন্দর উপস্থাপনা। এ ছাড়াও উত্তম সেন, রক্তিম ইসলাম, অনিলকুমার ঘাঁটা, খগেন অধিকারী, সাদরুল ইসলামের লেখা ভাল লাগে।

‘সাদা-কালোয় প্রজাপতি’, ‘ময়ূর কিংবা মানুষের মুখ’, প্রচ্ছদে অভিনব পরিকল্পনা পঞ্চম বর্ষে দীপায়ণ দাসের ‘প্রবাহিনী’। পরেশ ভট্টাচার্যের ‘প্রথম প্রেম’, সোমা মুখোপাধ্যায়ের ‘কথোপকথন’, কৃষ্ণা বসুর ‘মায়াবী ম্যাজিকওয়ালা’ বেশ ভাল লাগে। পত্রিকায় পঁচাত্তর জন লেখকের লেখা প্রকাশ করে প্রবীণদের পাশাপাশি নবীনের লেখার জায়গা করে দেওয়ার ভাবনা আগামী দিনে সাহিত্যজগত্‌ উপকৃত হবে। প্রখ্যাত কবি কবিতা সিংহ, কৃষ্ণা বসু এবং মল্লিকা সেনগুপ্ত এই তিন জনের পঁচিশটি করে কবিতা নিয়ে তপনকুমার মণ্ডলের পত্রিকা ‘আমার পত্রপূট’ ষষ্ঠ বর্ষে ভিন্ন মাত্রায় পৌঁছেছে। তিন কবির কবিতা ছাড়া তাঁদের লেখার বিশ্লেষণ করেছেন বল্লরী সেন, সম্রাজ্ঞী বন্দ্যোপাধ্যায়, মুনমুন গঙ্গোপাধ্যায়, মৌ দাশগুপ্ত, অরুণ পাঠক প্রমুখ। তিন কবির সাক্ষাত্‌কারও প্রকাশ করা হয়েছে বইটিতে। শর্বাণী দাশগুপ্তের প্রচ্ছদ প্রশংসার দাবি রাখে। বিশিষ্টজনের জীবনী এবং গল্প-কবিতায় ভরা মানস মুখোপাধ্যায়ের সম্পাদনা ‘রোদ্দুর’ এগারো বছরে পড়ল। শারদ সংখ্যাটি বেশ ঝকঝকে। প্রচ্ছদ পরিকল্পনা থেকে মুদ্রণ এবং পরিকল্পনা সব ক্ষেত্রেই দক্ষতার ছাপ রেখেছে সুব্রত দাশের ‘ছাতিম তলা’, পঙ্কজ অধিকারীর ‘গুরুদক্ষিণা’। তপন বন্দ্যোপাধ্যায়, পরিমল ঘোষ, স্বপন মল্লিক, মানস মুখোপাধ্যায়, অচিন মিত্র, পরিমল ঘোষের পরিণত লেখা পাঠকদের আনন্দ দেয়।

দ্বিতীয় বর্ষে পড়া শুভঙ্কর মণ্ডলের দীপাবলি সংখ্যা ‘তীর্থ’-র নতুন, পুরনোদের নিয়ে লেখাগুলি প্রশংসার দাবি রাখে। শিশুদের আঁকা ছবি এবং গল্প-কবিতার সঙ্গে ইলাস্ট্রেশন পত্রিকার গুণগত মান বাড়িয়েছে। দীপক আঢ্য-র শারদীয়া সংখ্যা ‘বিবস্বান’-এর প্রচ্ছদে দেবী দুর্গার মহিষাসুর নিধন পাঠকদের আকৃষ্ট করে। ছোটদের কথা থেকে শুরু করে প্রবন্ধ, কবিতা, গল্পে ভরা পত্রিকাটিতে ছাপা ছোটদের আঁকা ছবি আরও আকর্ষণীয়। চমত্‌কার কবিতা লিখেছেন শুভজিত্‌ সরকার, সন্দীপ রায়, শংকর সরকার, সমর দে। নবকুমার সরকারের পাক্ষিক ‘সংবাদ কলাসঙ্গম’ এবং মলয় দাসের ‘জেলা হিতৈষী’-ও গল্প, কবিতা-সহ সমকালীন সংবাদ পরিবেশন করে শহরবাসীর নজর করেছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE