ইছামতী সেতুতে রাতে তল্লাশি পুলিশের।—নিজস্ব চিত্র।
চুরি, ছিনতাই এবং মাতালের উৎপাত ঠেকাতে কড়া দাওয়াইয়ের পরিকল্পনা নিয়েছে বসিরহাট থানার পুলিশ। রাস্তার মোড়ে মোড়ে ‘দুষ্কৃতী ধরতে প্রশাসনকে সাহায্য করুন’ এমন বার্তা লেখা ফ্লেক্স ঝোলানোর পাশাপাশি স্কুল-কলেজের সামনে মহিলা পুলিশ নিয়োগ করা হয়েছে। সন্ধ্যা থেকে রাত পর্যন্ত পাড়ায় পাড়ায় সাদা পোশাকের পুলিশি টহল চলছে। ফলও মিলছে। গত সপ্তাহ দু’য়েকের মধ্যে কয়েক জন দাগি দুষ্কৃতী ধরা পড়ার পাশাপাশি জাল নোট, অস্ত্র উদ্ধার হয়েছে। চোলাই ব্যবসায়ী গ্রেফতার হয়েছে। চোলাইয়ের ঠেক ভেঙে কয়েক হাজার লিটার চোলাই নষ্ট করা হয়েছে বলেও দাবি পুলিশের। বসিরহাট থানায় নতুন আইসি আসার পরে এত সব করা হলেও আইন-শৃঙ্খলা নিয়ে কিছু সমস্যা কিন্তু থেকেই যাচ্ছে। পুলিশের দাবি, ২৬৭ স্কোয়ার কিলোমিটারের মধ্যে একটি মাত্র থানা। প্রায় ৮ লক্ষ মানুষের নিরাপত্তায় ১৬ জন অফিসার, ২৫ জন পুলিশকর্মী এবং ৩ টি মাত্র গাড়ি সম্বল।
সম্প্রতি বসিরহাটের সাঁইপালায় একটি খুনের ঘটনাকে কেন্দ্র করে পুলিশ মহলে খানিকটা রদবদল হয়েছে। বসিরহাট থানার আইসি-সহ চার অফিসারকে সরিয়ে দেওয়া হয়। নতুন আইসি হয়ে আসেন গৌতম মিত্র। অফিসার পরিবর্তন হলেও কিন্তু চুরি, ছিনতাই, খুন বন্ধ থাকেনি। বরং সন্ধ্যার পরে বাড়ি ছেড়ে বের হলেই চুরির ঘটনা ঘটেছে নানা সময়ে। যা নিয়ে আতঙ্কিত বসিরহাটবাসী। গত কয়েক দিনে শহরে অন্তত পনেরোটি বাড়ি ও দোকানে লুঠপাট চালানোর ঘটনা ঘটেছে। বসিরহাটের চৌমাথায় টাকি রোডের ধারে পুলিশকর্মী নিতাই দত্তের বাড়িতেও হানা দিয়েছে দুষ্কৃতীরা। তার দু’দিন আগেই সংগ্রামপুরে গৃহশিক্ষক ডাকু ঘোষের ঘরের দরজা ভেঙে ভিতরে ঢুকে ল্যাপটপ, মোবাইল-সহ নানা জিনিসপত্র নিয়ে পালিয়েছে দুষ্কৃতীরা। চুরির হয়েছে মির্জাপুরের শ্যামলী মুখোপাধ্যায়ের বাড়িতেও। পুলিশের কাছে করা অভিযোগে শ্যামলীদেবী জানান, নিমন্ত্রণ বাড়ি থেকে রাত ১০টা নাগাদ ফিরে দেখেন, বাইরের বারান্দার গ্রিল এবং দরজা ভাঙা। আলমারি ভেঙে টাকা, অলঙ্কার, ক্যামেরা নিয়ে পালিয়েছে দুষ্কৃতীরা। কাছারিপাড়ার এক ওষুধ ব্যবসায়ী কল্যাণ কুণ্ডুর নতুন বাড়িতে ঢুকে দুষ্কৃতীরা নগদ টাকা, গয়না নিয়ে পালায়। রাত সাড়ে ৯টা নাগাদ বাড়ি ফিরে চুরির ঘটনা জানাজানি হলে তাঁদের পুরনো বাড়ি থেকে সকলে নতুন বাড়িতে চলে আসেন কল্যাণবাবুরা। সেই সুযোগে দুষ্কৃতীরা ওই ব্যবসায়ীর পুরনো বাড়ির দরজা ভেঙে লুঠপাট করে পালায়। রেজিস্ট্রি অফিস মোড়ে চা দোকানি রমেশ মণ্ডলের গ্যাস সিলিন্ডার চুরি যায়। সাঁইপালায় এক ঠিকাদারের বাড়িতেও লুঠপাট চলে। ব্যবসায়ী দেবদাস দাস, শিক্ষক ভূপতি মণ্ডল-সহ গোয়ালপোতা, শোনপুকুরধান এবং সাঁইপালা এলাকার বেশ কয়েকটি বাড়িতেও চুরির ঘটনায় উদ্বিগ্ন স্থানীয় বাসিন্দারা। এরই মধ্যে দালালপাড়ায় জোড়াপুকুরে খুন হয়ে যান অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষিকা লতিকা দে।
একের পর এক এমন ঘটনায় নড়েচড়ে বসেছে মহকুমা পুলিশ-প্রশাসন। পুলিশের দাবি, নজরদারি আরও বাড়ানো হয়েছে। চুরি ঠেকাতে সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত সাঁইপালা, বদরতলা, ইছামতী সেতু, টাউনহল, ময়লাখোলা, স্টেশনপাড়া, হরিশপুর, শ্মশানঘাট এবং বদরতলা-সহ ১২টি স্পটে ৬৬ জন সিভিক ভলান্টিয়ারকে পাহারায় বসিয়ে ফল মিলেছে। সাদা পোশাকে পাহারা বসানো হয়েছে স্কুল-কলেজ এবং ধর্মীয়স্থানের সামনে। অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষিকাকে খুনের ঘটনায় জড়িত সাত জন ছাড়াও আরও ১৬ জন দুষ্কৃতীকে নানা ঘটনায় গ্রেফতার করা হয়েছে। প্রায় ১৫ হাজার টাকার জাল নোট-সহ ৩ দুষ্কৃতীকে গ্রেফতার করে ৩টি রিভালবার উদ্ধার হয়েছে। বেশ কয়েকটি চোলাইয়ের ঠেক ভেঙে দিয়ে ৩ ব্যবসায়ীকে ধরার পাশাপাশি দেড় হাজার লিটারের মত চোলাই নষ্ট করা হয়েছে। ওয়ারেন্ট থাকা ৬০ জনকে ধরা হয়েছে।
কিন্তু এত সব করেও কি সীমান্ত শহর বসিরহাটকে দুষ্কৃতী-মুক্ত করা যাবে?
এক পুলিশকর্তার কথায়, “আইনরক্ষদের সদিচ্ছাই শুধু বড় কথা নয়। রাজনৈতিক বাধা এবং পরিকাঠামোর অভাবও অনেক সময়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়।” ওই পুলিশ কর্তা জানান, বসিরহাট থানা এলাকায় লোকসংখ্যা গত কয়েক বছরে বেশ কয়েক গুণ বেড়েছে। কিন্তু পুলিশের পরিকাঠামোয় বিশেষ উন্নতি ঘটেনি। এই থানার অন্তর্গত একটি পুরসভা এবং দু’টি ব্লকের ১৬টি পঞ্চায়েত। মোট ২২ কিলোমিটার সীমান্ত এলাকা। ৩৫টি ব্যাঙ্ক, একটি কলেজ, শতাধিক স্কুল, আদালত, মহকুমাশাসক, মহকুমা পুলিশ আধিকারিকের অফিস, দমকল, সংশোধনাগার, বেশ কয়েকটি সরকারি-বেসরকারি দফতর, কয়েকশো দোকান এবং কয়েক হাজার বাড়ি এ সব তো আছেই, আর আছে সীমান্ত এলাকা হওয়ায় কিছু বাড়তি সমস্যাও। সব মিলিয়ে তিনটি গাড়ি এবং দিনে ২৪ লিটার তেল নিয়ে কতটা পরিষেবা দেওয়া সম্ভব, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে পুলিশ মহলেই। বসিরহাটের মানুষের দাবি, বসিরহাট থানাকে ভেঙে আরও একটি থানা করা হোক। বাড়ানো হোক পুলিশি পরিকাঠামো। সে সব যত ক্ষণ না হচ্ছে, পুলিশ আপাতত চাইছে বিভিন্ন এলাকায় সিভিক ভলান্টিয়ারদের ব্যবহার করা। অন্তত খবর আনা-নেওয়ার কাজটা করতে পারলেও দুষ্কৃতীদের উপদ্রব অনেকটা কমবে বলে তাঁদের আশা। সে কারণে জনসংযোগও বাড়াতে চাইছে পুলিশ। বসিরহাট থানার আইসি গৌতম মিত্র বলেন, “আরজি পার্টি গঠন করে এলাকার মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ানোর চেষ্টা শুরু হয়েছে।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy