Advertisement
১১ মে ২০২৪

দুর্গাপুজোর থেকেও জনপ্রিয় গ্রামের নাটক প্রতিযোগিতা

বহু বছর আগের কথা। সালটা ১৯৭৬। গ্রামে অনুষ্ঠিত হয় নাটক এবং অন্য নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। স্থানীয় শিক্ষিত কয়েক জন মানুষের উদ্যোগে মথুরাপুর ২ ব্লকের রাধাকান্তপুর পঞ্চায়েত এলাকায় উন্নত সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল গড়ে তুলতে আটেশ্বরতলা মোড়ে এই উদ্যোগ। তক্তপোষের মঞ্চে বিছানার চাদর জুড়ে, পাটের দড়ি দিয়ে সেলাই করে হ্যারিকেন জ্বালিয়ে হয়েছিল সে বারের অনুষ্ঠান।

অমিত করমহাপাত্র
মথুরাপুর শেষ আপডেট: ১৮ অক্টোবর ২০১৪ ০০:১৭
Share: Save:

বহু বছর আগের কথা। সালটা ১৯৭৬। গ্রামে অনুষ্ঠিত হয় নাটক এবং অন্য নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। স্থানীয় শিক্ষিত কয়েক জন মানুষের উদ্যোগে মথুরাপুর ২ ব্লকের রাধাকান্তপুর পঞ্চায়েত এলাকায় উন্নত সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল গড়ে তুলতে আটেশ্বরতলা মোড়ে এই উদ্যোগ। তক্তপোষের মঞ্চে বিছানার চাদর জুড়ে, পাটের দড়ি দিয়ে সেলাই করে হ্যারিকেন জ্বালিয়ে হয়েছিল সে বারের অনুষ্ঠান। তাতে অবশ্য মানুষের মন ভরেনি। কিন্তু উদ্যোক্তারাও দমেননি। পরের বছর থেকেই তাঁরা শুরু করেন একাঙ্ক নাটক প্রতিযোগিতা। সাফল্যের সেই শুরু। আটেশ্বরতলা সাংস্কৃতিক মঞ্চ আয়োজিত সেই অনুষ্ঠান এখন হয় চার দিন ধরে। রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে নাটক মঞ্চস্থ করতে আসে তিরিশটিরও বেশি নাট্য দল। সন্ধ্যা থেকে সারা রাত তেরোটি নাটক মঞ্চস্থ হওয়ারও নজির রয়েছে। স্থানীয়দের মতে, দুর্গাপুজোর থেকেও এখন জনপ্রিয় এই নাট্যোত্‌সব।

মঞ্চের সহ সভাপতি চিকিত্‌সক হরিসাধন গায়েনের বক্তব্য, “গ্রামীণ উত্‌সবগুলি ছিল বিনোদনের। পাশাপাশি লোকশিক্ষার মাধ্যমও। কিন্তু সামাজিক অবক্ষয়ের ফলে যুবসমাজের যে অবনমন ঘটছে, তাতে লোকশিক্ষার মাধ্যমগুলি অবলুপ্ত হচ্ছিল। তাই এই প্রচেষ্টা।” অশ্লীলতা বর্জিত সমাজ সচেতনতামূলক ও প্রগতিশীল নাটক মঞ্চস্থ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন উদ্যোক্তারা। তাঁদের বক্তব্য, এই কাজে পাওয়া যাচ্ছে সমাজের সব শ্রেণির মানুষের সক্রিয় সহযোগিতা। হরিসাধনবাবুর কথায়, “বছরভর ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক শিক্ষা ও চর্চারও সুযোগও করা হয় মঞ্চের পক্ষ থেকে।”

এ বছর ১৬-১৯ অক্টোবর চলছে এই অনুষ্ঠান। পিছিয়ে পড়া এই প্রত্যন্ত এলাকায় এত বছর ধরে এমন উদ্যোগ যে ব্যতিক্রমী, তা মানছেন নাট্যপ্রেমীরা। পূর্ব মেদিনীপুরের নাট্যদল ‘শিল্পকৃতী’-র সম্পাদক সুরজিত্‌ সিংহ বলেন, “নাটকের জন্য বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে গিয়েছি। কিন্তু সারা রাত ধরে নাটকের এমন প্রতিযোগিতার কথা কোথাও শুনিনি। এমন মঞ্চে নাটক মঞ্চস্থ করা যে কোনও দলের কাছে সম্মানের।” বারুইপুরের বাসিন্দা পেশায় চিকিত্‌সক নাট্যপ্রেমী মনোরঞ্জন মণ্ডল। বেশ কয়েকবার এসেছেন এই অনুষ্ঠানে। তাঁর অভিজ্ঞতায়, “এখানকার নাটকগুলি বৈচিত্রপূণর্। সন্ধে থেকে শুরু। শেষ হয় ভোর রাতে। সকলে বসে থাকেন অসীম ধৈর্য্য নিয়ে। হাজার হাজার দর্শক।” তিনি বলেন, “গ্রামের মানুষের কাছে বিনোদনের সুযোগ বিশেষ থাকে না বলে দর্শকদের এত ভিড় হয় এই অনুষ্ঠানে। কিন্তু বছরের পর বছর ধরে একই চিত্র প্রমাণ করে, নাটকের প্রতি স্থানীয় মানুষের রুচিও অন্য রকম।”

মঞ্চের অন্যতম সংগঠক গুণসিন্ধু হালদার জানান, এ বার চার দিনে মঞ্চস্থ হচ্ছে ৩২টি দলের ৩২টি নাটক। কলকাতা ও দুই ২৪ পরগনা-সহ মোট আটটি জেলা থেকে এসেছে দলগুলি। সংস্থার নিজস্ব স্থায়ী মঞ্চে এই নাটক আয়োজন করা হয়। এলাকায় দু’টি পেশাদার নাট্যদল থাকলেও এই সংস্থার নিজস্ব কোনও নাট্য দল নেই।

সংস্থার এমনই কর্মকাণ্ড দেখে প্রভাবিত হয়ে ২০১১ সালে আটেশ্বরতলায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশে দু’কাঠা জমি দান করেছিলেন গিলারছাটের বাসিন্দা শিক্ষক সব্যসাচী বৈদ্য। তিনি বলেন, “স্থায়ী মঞ্চ ও অন্যান্য পরিকাঠামো তৈরি হলে ওই সংস্থা এলাকায় আরও সুস্থ সাংস্কৃতিক চর্চা বাড়াতে পারবে। তাই জমি দিয়েছি।” ইতিমধ্যে ওই জমিতে আন্ডারগ্রাউন্ড বাদে তৈরি হয়েছে দোতলা ভবন। স্থানীয় পঞ্চায়েত সমিতি ৬ লক্ষ ও স্থানীয় ভাবে আরও ১২ লক্ষ টাকা সংগ্রহ করে বর্তমানে ওই কাঠামো গড়ে তোলা হয়েছে। সব্যসাচীবাবু বলেন, “আমাদের লক্ষ্য, স্থায়ী ভাবে নিয়মিত বিনামূল্যে কোচিং সেন্টার, চিকিত্‌সা ব্যবস্থা করা। সেই সঙ্গে ব্যয়ামাগার, সাংস্কৃতিক কলাশিক্ষার কক্ষ তৈরিও ইচ্ছে আছে।” তবে সে জন্য আরও টাকার দরকার বলে জানালেন সকলে।

কর্মসূত্রে অন্য জেলায় থাকলেও এই ক’টা দিন অবশ্যই বাড়িতে থাকেন নলপুকুরের সুজন হালদার, আটেশ্বরতলার মৌসুমী গায়েনরা। তাঁদের কথায়, “ছেলেবেলা থেকেই এ সব দেখে আসছি। এই ক’দিন বাড়িতে আত্মীয়দের ভিড় থাকে। এই উপলক্ষে তাঁদের আমন্ত্রণ করা যেন প্রত্যেকের পারিবারিক রেওয়াজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ এটাই এলাকার প্রধান উত্‌সব।” প্রবীণ অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক জগন্নাথ হালদারের স্মৃতিচারণ, “আগে আগে হুেঁকা, কলকে, মালসা, আগুন নিয়ে সারা রাত জেগে থেকে নাটক দেখতেন প্রৌঢ়রা। রাতভর নাটক দেখতেন বাড়ির মহিলারাও। এই অনুষ্ঠান ঘিরে তিরিশ বছর আগের আগ্রহে আরও জোয়ার এসেছে।” গিলারছাটের বধূ ললিতা পুরকাইত, নলপুকুরের প্রতিমা মণ্ডলরা বলেন, “এত নাটক দেখার সুযোগ তো কোথাও মেলে না। টিভিতে নিয়মিত সিরিয়াল দেখলেও এর আকর্ষণই আলাদা।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

amit karmahapatra southbengal play competition
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE