লাগল যে দোল...। বৃহস্পতিবার বনগাঁয় তোলা নিজস্ব চিত্র।
কোথাও তখন ভেসে আসছে, “ওরে ভাই ফাগুন বনে বনে”, কোথাও আবার শোনা যাচ্ছে “রাঙিয়ে দিয়ে যাও যাও যাও গো এ বার যাওয়ার আগে....।”
বৃহস্পতিবার বনগাঁর দোল একেবারে অন্য রকম। ঠিক যেন এক টুকরো শান্তিনিকেতন। শহরে এমন চিত্র দোল উৎসবে আগে কখনও দেখা যায়নি।
সকাল থেকেই বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে আয়োজিত দোল উৎসবে সামিল হয়েছিলেন শহরের বহু মানুষ। নানা বয়সের মানুষের উপস্থিতিতে বসন্ত উৎসব অন্য মাত্রায় পৌঁছল। এমনিতে সাংস্কৃতিক শহর হিসাবে উত্তর ২৪ পরগনার এই অংশের নামডাক আছে। পুজোর সময়ে বহু সাহিত্য পত্রিকা বের হয় বনগাঁ থেকে। ২১ ফেব্রুয়ারি ঘটা করে পালিত হয় ভাষা উৎসব। বসন্ত উৎসবও দেখিয়ে দিল, বনগাঁবাসীর রুচিবোধ।
সকাল থেকে একের পর এক শোভাযাত্রা বের হয় শহরে। শোভাযাত্রায় পুরুষদের পরনে ছিল সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি। প্রথম বসন্তের ভোরের আলোয় হলুদ শাড়িতে সেজে উঠেছিলেন মেয়েরা। প্রত্যেকেই একে অপরকে আবির মাখিয়ে দেন। পথচলতি মানুষও রঙের উৎসবের আলিঙ্গন থেকে বাদ পড়েননি। তাঁদের সঙ্গেও চলে আবির বিনিময়। মিষ্টিমুখ করানো হয়। কোথাও আবার মাঠ জুড়ে বিভিন্ন গান ও নাচের মাধ্যমে পালিত হল বসন্ত উৎসব। যশোহর রোডের পাশে কিছু ছেলে মেয়ে বসে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করেন, আবির খেলেন।
স্থানীয় বলাকা সমিতি ক্লাবের পক্ষ থেকে কালীবাড়ি মোড়ের কাছে সমিতির মাঠ জুড়ে দোল উৎসবের আয়োজন করা হয়েছিল। যেখানে কৃষ্ণনগর থেকে গানের শিল্পী এসেছিলেন। সকাল থেকেই একের পর এক এলাকার ছেলে মেয়েরা সেজে গুজে অনুষ্ঠানে হাজির হন। সকাল সাড়ে ১০টা থেকে শুরু হয় উৎসব। গানের তালে পাল্লা দিয়ে চলে নাচ। মেয়েরা থালায় বিভিন্ন রঙের আবির সাজিয়ে সকলকে মাখিয়ে দিচ্ছিলেন। সঙ্গে উপহার হিসাবে একটা করে পলাশ ফুল দিচ্ছিলেন। পলাশের মালা পরিয়ে বরণপর্ব চলে। এ পাড়ার সব মানুষ একত্রিত হয়ে প্রকাশ্যে শান্তিনিকেতনের আদলে নাচছেন, গাইছেন আবির খেলছেন এমন দৃশ্য অতীতে এই এলাকার মানুষ কখনও দেখেননি।
স্থানীয় শক্তিগড় এলকার বাসিন্দা নৃত্যশিল্পী অস্মিতা বসু বলেন, “নাচ শিখেছি, এখন নাচ শেখাই। তবে এই প্রথম পাড়ার সকলে মিলে দোল উৎসবে নাচ করছি। ভীষণ ভাল লাগছে।” অনুষ্ঠানে খাওয়া-দাওয়ারও ব্যবস্থা ছিল। অনুষ্ঠানে উপস্থিত বছর চল্লিশের শিউলি চক্রবর্তী নামে এক স্থানীয় বাসিন্দা বলেন, “অনুষ্ঠানের পর খিচুরি, আলুর দম ও জিলিপি খাওয়ানো হবে। ফলে আজ এখানেই সব কিছু।” রঙ মেখে নাচতে দেখা গেল ষাট বছরের রমা দে নামে এক বৃদ্ধাকে। তাঁর কথায়, “আজকে মনে হচ্ছে জীবনটা স্বার্থক। এলাকার সকলে মিলে এমন একটি উৎসবে সামিল হতে পেরে খুবই আনন্দ হচ্ছে।” স্থানীয় বাসিন্দা মিতালি চক্রবর্তীর এ বার শান্তিনিকেতনে দোল উৎসবে যাওয়ার কথা ছিল। অতীতে গিয়েওছেন অনেকবার। কিন্তু কোনও কারণে এ বার যেতে পারেননি। তবে এখানেই শান্তিনিকেতনের মতোই দোল উপভোগ করলেন বলে তিনি জানালেন। মিতালিদেবীর কথায়, “শান্তিনিকেতনে না যেতে পারার দুঃখটা এখানে এসে ভুলে গিয়েছি।” করতালি দিয়ে স্ত্রীকে উৎসাহ দিচ্ছিলেন দেবব্রত বিশ্বাস, সুরজিৎ ঘোষ, অনিমেশ তরফদার, সুবীর ভট্টাচার্যরা। তাঁরা বলেন, “অসাধারণ অভিজ্ঞতা। আগামী দিনে আরও বড় করে দোল উৎসব করার পরিকল্পনা রয়েছে।”
বনগাঁ শহরে স্থানীয় অভিযান সঙ্ঘ, স্বামীজি স্পোর্টিং ক্লাব, সিদ্ধেশ্বরী কালীমন্দির, বারোর পল্লি লোকনাথ মন্দির কমিটি, রাধাকৃষ্ণ সেবাকুঞ্জ, আমলাপাড়া অ্যাথলেটিক ক্লাব সব আরও কিছু সংগঠনের পক্ষ থেকে দোল উত্সব পালন করা হয়েছে। সঙ্ঘের সম্পাদক তথা প্রবীণ শিক্ষক তুহিন ঘোষ বলেন, “আমরাই প্রথম শহরে দোলের দিন শোভাযাত্রা শুরু করেছিলাম। এ বার দেখলাম অনেক সংগঠনই শোভাযাত্রা করেছে। শহরের সামাজিক সংস্কৃতিকে তুলে ধরেছে।” বাটারমোড়, ত্রিকোণ পার্ক, মতিগঞ্জ এলাকায় অনুষ্ঠান করা হয়। শোভাযাত্রায় গাড়িতে বসেই শিল্পীরা গাইছিলেন। শিমুলতলার রাধাকৃষ্ণ সেবাকুঞ্জের পক্ষ থেকে কীর্তন শিল্পীদের শোভাযাত্রায় সামিল করা হয়েছিল। বনগাঁ পুরসভার চেয়ারম্যান জ্যোত্স্না আঢ্য ওই শোভাযাত্রায় ছিলেন। তিনি নিজেও পথচলতি মানুষকে আবির মাখিয়েছেন। সকলকে লাড্ডু দেওয়া হয়েছে। কর্তব্যরত র্যাফ ও পুলিশকেও আবিরের তিলক পড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। শোভাযাত্রায় হাঁটার সময়ে শিক্ষক সুব্রত বক্সি বলেন, “আজকে যেন আমাদের শহরটার এক অন্য রূপ দেখছি। এখানে অতীতে এমনটা দেখা যায়নি।”
আগামী বছর থেকে বনগাঁ স্টেডিয়ামে সব সংগঠনকে নিয়ে দোল উত্সবের আয়োজন করা হলে পুলিশ সহযোগিতা করবে বলে জানান এক পুলিশ কর্তা। এ বার শহরে দোলের দিন কোনও অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। মদ্যপ অবস্থায় যুবকদের মোটরবাইক নিয়ে দাপাদাপিও চোখে পড়েনি। অতীতের মতো দোলের দিন মদ্যপ যুবকদের মধ্যে মারামারি, গুলি-বোমা বিনিময়ও ঘটেনি। অনেক মানুষ যারা প্রয়োজনে পথে বেরিয়ে ছিলেন, তাঁরাও প্রথমে একটু দ্বিধায় ছিলেন। কিন্তু শোভাযাত্রা দেখে তাঁরাও ভরসা পান।
সব মিলিয়ে উৎসব ও আবেগের রঙে ভেসে গেল বনগাঁ।
অন্য দিকে, দক্ষিণ ২৪ পরগনার মথুরাপুরের রামনগর বাপুলি বাজার মিলন মিতালি সঙ্ঘের পরিচালনায় বসন্ত উৎসব পালিত হয়েছে। শুক্রবার বিকেলে মথুরাপুর-১ বিডিও অফিসের মাঠে ওই অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়। অনুষ্ঠান শুরুর আগে কচিকাঁচাদের নিয়ে পথ পরিক্রমা হয়। সঙ্ঘের পক্ষে সুমন পুরকাইত বলেন, “শান্তিনিকেতনের অনুকরণে এই ধরনের অনুষ্ঠান আমরা গত তিন বছর ধরে করছি।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy