Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

বাওরে ফোটা পদ্মের বনে শারদীয়া উত্‌সবের ইশারা

ইতিউতি নীলকণ্ঠ পাখির ওড়াউড়ি। আকাশে সাদা মেঘের স্তূপ। ঝোপের আড়াল থেকে উঁকি মারা হাতেগোনা গুটি কতক কাশ ফুল। বাওর জুড়ে ফোটা পদ্ম। এ ছাড়া বছরের আর পাঁচটা দিনের থেকে পুজোর দিনগুলির বিশেষ কোনও পার্থক্য নেই এখানকার মানুষের কাছে। দূর থেকে ভেসে আসা ক্ষীণ ঢাকের শব্দ শুনে গ্রামবাসীরা বলাবলি করেন, পুজো শুরু!

রোজকার মতোই খেলায় মেতেছে শিশুরা। ছবি: নির্মাল্য প্রামাণিক।

রোজকার মতোই খেলায় মেতেছে শিশুরা। ছবি: নির্মাল্য প্রামাণিক।

সীমান্ত মৈত্র
বনগাঁ শেষ আপডেট: ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০১:২৫
Share: Save:

ইতিউতি নীলকণ্ঠ পাখির ওড়াউড়ি। আকাশে সাদা মেঘের স্তূপ। ঝোপের আড়াল থেকে উঁকি মারা হাতেগোনা গুটি কতক কাশ ফুল। বাওর জুড়ে ফোটা পদ্ম।

এ ছাড়া বছরের আর পাঁচটা দিনের থেকে পুজোর দিনগুলির বিশেষ কোনও পার্থক্য নেই এখানকার মানুষের কাছে। দূর থেকে ভেসে আসা ক্ষীণ ঢাকের শব্দ শুনে গ্রামবাসীরা বলাবলি করেন, পুজো শুরু!

শারদ উত্‌সবের অনুভূতি এখানে ধাক্কা খেয়েছে কাঁটাতারে। প্রতি বছর এ ভাবেই পুজো আসে-যায় বাগদার সীমান্তবর্তী কাশীপুর, বেড়বাড়ি, জিত্‌পুর, রাজকোল, কুলিয়া, আউলডাঙা গ্রামে।

কাশীপুরের বর্ডার রোডের পাশে কোদালিয়া নদীর উপর একটি সেতু রয়েছে। সেতুর মুখে বিএসএফ চৌকি। রাস্তার পাশে বাঁশের বেড়ার গেট। তাতে তালা ঝুলছে। ওই বন্ধ গেটের ভিতরেই হিন্দু-মুসলিম মিলিয়ে এখানকার গোটা ২৫ পরিবারের বাস। গেটের ভিতরে ঢুকতে হলে প্রয়োজন বিএসএফের ঊর্ধ্বতন কর্তাদের অনুমতি। পুলিশ বা সাংবাদিক, যেই হোন না কেন। অনুমতি পেলে নাম ঠিকানা বিএসএফের খাতায় নথিভুক্ত করে মিলবে ঢোকার ছাড়পত্র। তবে একবার ঢুকে পড়লে কোথায় ভারতের সীমানা শেষ হয়ে বাংলাদেশ শুরু হচ্ছে, বোঝার কোনও উপায় নেই। জানা গেল, কাঁটাতারের পর দেড়শো মিটার জমি ভারতের অধীনে। ভারতের মূল ভূখণ্ডে ঢুকতে গেলে অবশ্য ওই কাঁটাতারের গেট পার করতেই হয়।

বর্ডার রোডে কয়েক হাত অন্তর বিএসএফ জওয়ানেরা রাইফেল হাতে পাহারারত। অচেনা কাউকে দেখলেই থামিয়ে চলছে তল্লাশি। ওয়াচ টাওয়ারে দূরবিন হাতে জওয়ানদের সর্তক দৃষ্টি। এ সবের মধ্যে পুজো কোথায়? কাঁটাতারের গা ঘেঁষে পিচ রাস্তার পাশে ডোবার জলে শুধু ভিড় করেছে ঝাঁকে ঝাঁকে বক, শামুকখোল। আর কাঁটাতারের বাইরে দিগন্ত জোড়া ধান খেত। দূরে বাংলাদেশের বিমূর্ত সীমানা। এলাকায় দু’একটি পুজো হলেও তাকে ঘিরে মনে আলাদা কোনও অনুভূতি তৈরি হয় না।

পঞ্চমীর সকাল। এলাকায় গিয়ে দেখা গেল, পুজো নিয়ে ভূখণ্ডের মানুষের কোনও আবেগ-উত্তেজনা নেই। নেই পুজোর কেনাকাটার ব্যস্ততা। রাজহাঁসের দল রোজকার মতো ছোটাছুটি করছে। লোকজন খেতে কাজ করছেন। কচিকাঁচারা নিজের মনে খেলা করছে। মহিলারা সাংসারিক কাজে ব্যস্ত। গৃহবধূ রূপা দাসের স্বামী স্বপন খেত মজুর। পুজোর কেনাকাটা হয়েছে? প্রশ্ন শুনে অবাক হয়ে বললেন, “এখনও হয়নি তো।” কবে হবে বলতে পারলেন না। এক প্রৌঢ়া বললেন, “গেটের বাইরে একটা পুজো হয়। সেখানে মাঝে মধ্যে যাই। তবে, যেতে হলে বাড়িতে কাউকে রেখে যেতে হয়। না হলে বাংলাদেশ থেকে এসে ঘরের জিনিসপত্র, এমনকী গরুও ওরা চুরি করে নিয়ে যায়।”

এখানকার কেউই বনগাঁয় ঠাকুর দেখতে যান না। বাসিন্দারা জানালেন, কাঁটাতার বসানোর আগে থেকেই তাঁরা এখানে বসবাস করছেন। ক্ষোভ উগরে দিয়ে বললেন, “অথচ আমাদের খাঁচায় পুড়ে দেওয়া হল। খালি চোখে বাংলাদেশের সঙ্গে এই এলাকার কোনও পার্থক্য নেই। কাঁটাতারও নেই। অবাধ যাতায়াতের সুযোগ।” এলাকারই এক মহিলা বলেন, “পুজো বলে আমাদের গেটের বাইরে আসা-যাওয়ার জন্য কোনও ছাড় দেওয়া হয় না। নিজ ভূমিতেই আমরা পরাধীন। পুজো তো অনেক পরের ব্যাপার।” এখানকার অনেকেই চান মূল ভূখণ্ডে চলে যেতে। কিন্তু আর্থিক কারণে পারেন না।

আলোর জৌলুস, বড় মণ্ডপের জাঁকজমক, থিমের প্রতিমা এ সব এখানকার মানুষের কছে অলীক কল্পনা। রাত ৮টার পরে সাধারণ ভাবে গেটের বাইরে বেরনো নিষিদ্ধ।

এক বৃদ্ধের কথায়, “আমাদের আবার পুজো! বাড়ি বসে ঢাকের আওয়াজ শুনি।”

গেটের বাইরে বেরিয়ে দেখা গেল সাইকেলে করে এক ব্যক্তি টিপ, কাচের চুরি ফেরি করছেন। পুজোতে বাচ্চারা খুব পছন্দ করে এ সব। গেটের বাইরে একটিই পুজো হয়, যেটি এ ক’দিন এলাকাবাসীর এক মাত্র আনন্দের ঠিকানা। এর মধ্যে কোনও গ্রামের অবশ্য একটি পুজো আয়োজন করার বা দেখারও সৌভাগ্য হয় না।

ফেরার পথে চোখে পড়ল একটি দোকানে পুজোর জামা কাপড় টাঙানো। ক্রেতা নেই। রোজকারের মতো কোদালিয়া নদীতে ছোটরা সাঁতার কাটছে। এক ব্যক্তি বললেন, “বাওরে পদ্ম ফুটলে বুঝতে পারি পুজো আসছে। ঢাকের আওয়াজও দূর থেকে ভেসে আসে। এটাই বা কম পাওনা কী?”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

bangaon simantra maitra pujo southbengal
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE