Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪

রাজার মুখোশ খুলুক, চায় নিহত বান্টির পরিবার

দড়ি ধরে যে টান মারা যায়, দেখিয়েছেন একরত্তি সায়ন্তিকার মা দেবশ্রী ঘোষ। সেই দড়ি ধরার লোকের সংখ্যা বাড়তে শুরু করল। রাজা দত্তের বিরুদ্ধে এ বার মুখ খুললেন তার নিহত অনুচর, বান্টির বাবা শক্তিপদ ঘোষ। গর্জে উঠলেন, ‘‘সবাই জানে আমার বছর চব্বিশের জলজ্যান্ত ছেলেটা কী ভাবে খুন হল। আমরা চাই, এ বার রাজার মুখোশ খুলুক। এর শেষ দেখব।’’

বান্টির (ইনসেটে) বাবা শক্তিপদ ঘোষ ও মা সাধনা ঘোষ।

বান্টির (ইনসেটে) বাবা শক্তিপদ ঘোষ ও মা সাধনা ঘোষ।

বিতান ভট্টাচার্য ও সুপ্রকাশ মণ্ডল
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৫ মে ২০১৬ ০৫:১৯
Share: Save:

দড়ি ধরে যে টান মারা যায়, দেখিয়েছেন একরত্তি সায়ন্তিকার মা দেবশ্রী ঘোষ।

সেই দড়ি ধরার লোকের সংখ্যা বাড়তে শুরু করল। রাজা দত্তের বিরুদ্ধে এ বার মুখ খুললেন তার নিহত অনুচর, বান্টির বাবা শক্তিপদ ঘোষ। গর্জে উঠলেন, ‘‘সবাই জানে আমার বছর চব্বিশের জলজ্যান্ত ছেলেটা কী ভাবে খুন হল। আমরা চাই, এ বার রাজার মুখোশ খুলুক। এর শেষ দেখব।’’

হালিশহরে ভোটের (২৫ এপ্রিল) আগের রাতে স্থানীয় বারেন্দ্র গলির সমাজপতি পরিবারের উপরে হামলা চালানোর অভিযোগ উঠেছিল সেখানকার উপ-পুরপ্রধান, তৃণমূলের রাজা দত্তের অনুচরদের বিরুদ্ধে। ভোটের দিন যাতে সে বাড়ির কেউ বুথে না যান, তা নিশ্চিত করতে ওই হামলা হয় বলে অভিযোগ। প্রহৃত হন গৃহকর্তা টিটু সমাজপতি ও তাঁর মেয়ে দেবশ্রী ঘোষ। হামলাকারীরা দেবশ্রীর তিন বছরের মেয়ে সায়ন্তিকাকেও রেয়াত করেনি। তা সত্ত্বেও চোখরাঙানি উপেক্ষা করে ভোট দিতে গিয়েছিলেন দেবশ্রী। ভোট দিতে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন পাড়ার লোকেদেরও।

এর পরেই রাজার নানা কীর্তি-কাহিনি সামনে আসতে থাকে। এলাকায় পুকুর ভরাট, গঙ্গা থেকে বালি তোলা, তোলাবাজি-সহ নানা বেআইনি কাজের অভিযোগ উঠতে থাকে রাজার বিরুদ্ধে। জানা যায়, যাবতীয় ‘অপকর্ম’ সম্পাদন করার জন্য রাজার ‘সেনা বাহিনী’র কথাও। সেই বাহিনীরই এক সদস্য ছিল তেঁতুলতলার বাসিন্দা, সৈকত ঘোষ ওরফে বান্টি। ২০১৪ সালের ১৬ জানুয়ারি যাকে খুন হতে হয়। পুলিশ ও সিআইডি রাজারই ছয় অনুচরকে গ্রেফতার করেছিল। তারা এখন জামিনে মুক্ত। মামলা চলছে কলকাতা হাইকোর্টে। রাজারই এক ঘনিষ্ঠ আনন্দবাজারের কাছে দাবি করেছিল, ‘রাজ-রোষে’ পড়ার জন্যই বান্টির ওই পরিণতি হয়। এ বার বান্টির বাবা শক্তিপদবাবু এবং মা সাধনাদেবীও একই দাবি করলেন।

বাড়ির নীচেই ডেকরেটরের ছোট্ট দোকান চালান বছর চুয়ান্নর শক্তিপদবাবু। বুধবার সকালে সেখানেই বসেছিলেন। ছেলের কথা জিজ্ঞাসা করা মাত্র বুকের মধ্যে জমে থাকা কষ্টটা যেন বেরিয়ে এল! বললেন, ‘‘আনন্দবাজারের খবর দেখে সাহস পেয়েছি। আর ভয় করি না। বান্টি আমার একমাত্র সন্তান ছিল। ওর খুনিদের ভয়ে গুটিয়ে থাকলে ওরা পেয়ে বসবে। আমি চাই এ বার রাজার আসল চেহারা সামনে আসুক।’’ কীসের ভয়? বৃদ্ধ বলেন, ‘‘দু’বছর ধরে রাজার লোকজন মুখ না খোলার জন্য হুমকি দিয়ে যাচ্ছে। মঙ্গলবারও বলেছে, নাম ফাটলে মাথাও ফাটবে। তবু আর চুপ থাকব না।’’

কেন খুন হতে হল বান্টিকে?

তার পরিবার সূত্রে জানা গিয়েছে, উচ্চমাধ্যমিকের পর কম্পিউটার শিখছিল বান্টি। তার মধ্যেই কাঁচরাপাড়া বাগমোড়ের কিশোরী পায়েলের সঙ্গে মন দেওয়া-নেওয়া। ২০১১-তে বিয়ে। সংসারের চাপে কাজ খোঁজা শুরু করে বান্টি। সেই সময় রাজা দত্তের এক আত্মীয় বান্টিকে রাজ্য বিদ্যুৎ বণ্টন সংস্থায় অস্থায়ী চাকরিতে ঢুকিয়ে দেয়। সেই সূত্রেই রাজার সঙ্গে বান্টির আলাপ। তাকে দলে টেনে নেয় রাজা। ছেলের হাতে কাঁচা টাকা দেখে মনে কু ডেকেছিল বাবা-মায়ের। বান্টি তাঁদের জানিয়েছিল, সে জমির ব্যবসা শুরু করেছে। সাধনাদেবীরা পরে জানতে পারেন, পুকুর ভরাট করে বহুতলের ব্যবসায় নেমেছে রাজা। ছেলেকে সরে আসতে বলেন তাঁরা। কিন্তু ততদিনে ‘রাজ-বাহিনী’র অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হয়ে গিয়েছে বান্টি। তবু বাড়ির বারণ শুনে নিজেকে সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা শুরু করে বান্টি। নিজে জমির ব্যবসা শুরু করে। সে কথা রাজার কানে পৌঁছয়। এ নিয়ে দলে ঝামেলা শুরু হয়। আর তার জেরেই বান্টি খুন হয় বলে অভিযোগ তার পরিবারের।

পায়েল এখন অন্যত্র রয়েছেন। ভোটের পরের রাতে ‘রাজ-বাহিনী’র হুমকির জেরেই তাঁকে সরিয়ে রাখা হয়েছে বলে জানান শক্তিপদবাবুরা। এ দিন ফোনে পায়েল দাবি করেন, ‘‘স্বামী বলেছিল, রাজা তাকে ঝামেলা মিটিয়ে নিতে বলেছিল। না হলে তাকে লাশ হয়ে যেতে হবে বলে হুমকি দিয়েছিল। সেটাই সত্যি হল।’’ ২০১৪ সালের ১৬ জানুয়ারির স্মৃতি এখনও টাটকা পায়েলের। তিনি বলেন, ‘‘ওই সন্ধ্যায় বান্টির মোবাইলে রাজার ফোন এসেছিল। ফোনের কথাবার্তায় বুঝতে পারি, আলোচনা করে কিছু মিটিয়ে নেওয়ার কথা হচ্ছিল। সেই যে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল, আর ফিরল না।’’

শক্তিপদবাবুর দাবি, বকুলতলায় গিয়ে তাঁরা অনেকের কাছে বান্টি-খুনের কথা জেনেছেন। বাড়ি থেকে বেরিয়ে বান্টি সেখানে রাজা দত্তের মাচায় গিয়ে বসে। সেখানে আরও অনেকে ছিল। রাজাও ছিল কাছাকাছি। কার যেন নির্দেশে ধীরে ধীরে খালি হয়ে যায় মাচা। কারওর জন্য অপেক্ষা করতে থাকে বান্টি। কিছুক্ষণ পর সেখানে একটি গাড়িতে করে পৌঁছয় পাপন, সোনাই আর সমর। শক্তিপদবাবুর অভিযোগ, ‘‘মৃত্যুর সময় হাসপাতালে বান্টি চিকিৎসকদের বলেছিল, সোনাই তাকে ডাকে। মাচা থেকে নেমে আসে সে। গাড়ি থেকে নেমে সোনাই জড়িয়ে ধরে বান্টিকে। তার পরেই পর পর দুটো শব্দ। গাড়িতে উঠে তিন জন চলে যায়। বুকে-পেটে গুলি নিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে সে।’’

এই পাপন, সমর পুলিশের কাছে ধরা দেয়। সোনাইকে পুলিশ গ্রেফতার করে। শক্তিপদবাবুর আবেদনের ভিত্তিতে সিআইডি মামলা হাতে নিয়ে রাজার আরও তিন শাগরেদকে ধরে। কিন্তু ‘মাথা’ যে এখনও অধরা, আক্ষেপ শক্তিপদবাবুর। তাঁর অভিযোগ, পুলিশ বারবার বোঝানোর চেষ্টা করেছে, ওদের মাথায় প্রভাবশালী রায়বাড়ির হাত হয়েছে। ওদের বিরুদ্ধে লড়ে কী হবে! কিন্তু বৃদ্ধ নাছোড়। পুলিশ অভিযোগ মানেনি।

পায়েল বলেন, ‘‘‘জানেন, এই বয়সেই আমি হাইকোর্ট, উকিল, জজ— সব বুঝে গিয়েছি। রাজার লোকেরা আমাকে রেহাই দেয়নি। মুখ না খোলার জন্য হুমকি দিয়েছে। খারাপ প্রস্তাব দিয়েছে। তবুও লড়াইটা জারি রেখেছি।’’

সপ্তাহখানেক আগে ওই এলাকার আর এক সাধারণ গৃহবধূর এমনই জেদ সাহস জুগিয়েছে পায়েলকে। দড়ি ধরে টান মারার সংখ্যাটা বাড়ছে।

ছবি: সজল চট্টোপাধ্যায়

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE