Advertisement
১১ মে ২০২৪

প্রোমোটার, দালালদের রমরমা বসিরহাট শহরে

কয়েক মাস আগে টাউন হলের কাছে একটি পুরনো বাড়িতে ভূতের উপদ্রব নিয়ে শোরগোল পড়েছিল বসিরহাট শহরে। পরে পুলিশ অনেক ঘেঁটে জানতে পারে, ওই বাড়ি প্রোমোটারদের কাছে বিক্রি করে দেওয়ার চক্করেই কিছু লোক ভূতের গল্প ফেঁদেছিল।

নির্মল বসু
বসিরহাট শেষ আপডেট: ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ০১:৪৪
Share: Save:

কয়েক মাস আগে টাউন হলের কাছে একটি পুরনো বাড়িতে ভূতের উপদ্রব নিয়ে শোরগোল পড়েছিল বসিরহাট শহরে। পরে পুলিশ অনেক ঘেঁটে জানতে পারে, ওই বাড়ি প্রোমোটারদের কাছে বিক্রি করে দেওয়ার চক্করেই কিছু লোক ভূতের গল্প ফেঁদেছিল।

দিন কয়েক আগে এক শিক্ষকের বাড়িতে রাতের অন্ধকারে ঢিল-পাথর ছোড়ে কিছু দুষ্কৃতী। ওই শিক্ষকের দাবি, তাঁর জমি কিনতে চেয়ে কিছু লোক এর আগে হুমকি দিয়েছে। এ বার ঢিল মেরে ভয় দেখাতে চাইছে।

এর আগে দালালপাড়ায় খুন হয়ে যান অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষিকা লতিকা দে। একা থাকতেন তিনি। তাঁকে খুনের ঘটনায় নাম জড়ায় এক শিক্ষকের। ধরাও পড়েন তিনি। জানা যায়, প্রোমোটারদের কাছে লতিকাদেবীর সম্পত্তি বেচে দু’পয়সা কামানোই ছিল খুনের পিছনে কারণ।

ইটিন্ডা রোডের ধারে থাকতেন গৃহশিক্ষিকা জয়শ্রী দত্ত বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনিও খুন হয়ে যান।

বসিরহাটে গত কয়েক বছরে জমিবাড়ির দাম যেমন হু হু করে বেড়েছে, তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে অপরাধ। ১০-১২ জনের ছোট দল পাকাচ্ছে কিছু লোক। তারাই বাড়ি বাড়ি গিয়ে জলের দরে জমি, পুরনো বাড়ি কেনার তদ্বির করছে। কখনও হুমকি, কখনও টাকার লোভ দেখিয়ে কাজ হাসিল করা হচ্ছে।

বসিরহাট শহরের বাসিন্দা এক মহিলার কথায়, ‘‘আমার ছেলেমেয়েরা বাইরে থাকে। কিছু দিন ধরেই জমি-বাড়ি বিক্রি করার জন্য চাপ দিচ্ছে কিছু লোক। সকলকেই চিনি। এত দিন সদ্ভাবও ছিল। কিন্তু হঠাৎ দেখছি, ওদের আচরণ কেমন বদলে গিয়েছে। বার বার বাড়ি এসে বলছে, মাসিমা, আপনার ছেলেমেয়েরা তো এখানে থাকে না। এ বার আপনারাও এ সব বেচেবুচে কলকাতার দিকে চলে যান। শান্তিতে থাকবেন।’’

এক বৃদ্ধের কথায়, ‘‘আমার এক মেয়ে। প্রোমোটারের লোক এক দিন এসে বলল, কাকু, মেয়েকে তো রাস্তাঘাটে একা চলতে ফিরতে হয়। ঝামেলা বাড়়িয়ে কী লাভ। ভাল দাম পাচ্ছেন। সম্পত্তি বেচে দিন।’’ বৃদ্ধের কথায়, ‘‘কাকে বলব এ সব কথা। থানা-পুলিশে গিয়ে লাভ হবে না কিছু, পড়শিরা পরামর্শ দিয়েছেন। ভাবছি কয়েক কাঠা যে জমিটা পড়ে আছে, সেটা ওদের হাতে বেচেই দেবো।’’ জমি কিংবা পুরনো বাড়ি কেনার জন্য এমনই মরিয়া বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী বসিরহাট শহরের কিছু লোক। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বিষয় থানা-পুলিশ পর্যন্ত গড়ায় না। আর অভিযোগ জানালেও কাজ হয় না বলে আরও অভিযোগ ওঠে। নানা রঙের রাজনীতির ছাতার তলায় আশ্রয় নিয়ে থাকে অভিযুক্তদের। প্রোমোটার, দালালদের চেহারা, হাবভাব দেখে রীতিমতো সিঁটিয়ে থাকেন শহরের আম জনতা। একজন তো বলেই ফেললেন, ‘‘আমার পাশের বাড়ির যে ছেলেটা বছর তিনেক আগেও গাড়ি চালাত, টালির চালের বাড়িতে থাকত, সেই এখন গাড়ি হাঁকিয়ে ঘোরে। ঝাঁ চকচকে দোতলা বাড়ি দেখলে মাথা ঘুরে যাবে। কোথা থেকে আসে এত টাকা?’’

শহরের অনেক বাসিন্দার সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, জমি-বাড়ি নিয়ে মামলা মোকদ্দমা সামলে নেওয়াও জমি মাফিয়াদের বাঁ হাতের খেলা। টাকা ছড়িয়ে সরকারি দফতরের এক শ্রেণির অসাধু কর্মীর চেষ্টায় জলা জমিও বাস্তু জমিতে পরিণত হয়।

জমি বিক্রিকে কেন্দ্র করে দুষ্কৃতীদের মধ্যে সংঘর্ষ, খুনোখুনির ঘটনাও ঘটছে আকছার। জমি নিয়ে দুষ্কৃতীদের নিজেদের বিবাদে গত কয়েক বছরে ভ্যাবলা, সাঁইপালা এবং ময়লাখোলা এলাকায় বেশ কয়েকজন খুন হয়েছে। মাস কয়েক আগে বসিরহাটের ময়লাখোলায় তিন জনের দেহ মেলে। তদন্তে জানা যায়, জমিজমা বিক্রির টাকার বখরা নিয়ে দুষ্কৃতীদের কোন্দলেই এই খুন।

ক’বছর আগেও বসিরহাট শহরের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া ইছামতী নদীর এক পা়ড়ে কাঁচা বাড়ি, অন্য পাড়ে ইটের তৈরি বড় জোর দোতলা কিছু বাড়ির দেখা মিলত। কিন্তু হালফিলে ছবিটা বিলকুল বদলে গিয়েছে। পাঁচ-ছ’তলা বড় বড় সুদৃশ্য ফ্ল্যাট উঠেছে। শহরে তৈরি হয়েছে শপিং মল। বড় বড় দোকান, শো-রুম এখন শহরে।

বসিরহাট পৃথক জেলাও হতে চলেছে। সে জন্যই আরও বাড়ছে জমি-বাড়ির দাম। কোথাও কোথাও এক-দেড় কাঠা জমির দাম ৩০-৪০ লক্ষ টাকা! ১০/১০ দোকান ঘরের দাম কোথাও কোথাও ১৫-২০ লক্ষ টাকা! লাভের গুড়ের গন্ধ পেয়েই ভিড় ভিন ভিন করছে একশ্রেণির অসাধু প্রোমোটার। যারা যে কোনও মূল্যে জমি-পুরনো বাড়ি হাতিয়ে কয়েক গুণ বেশি দামে বিক্রি করে দিতে মরিয়া।

এক পুলিশ অফিসারের কথায়, ‘‘একদল দুষ্কৃতীর জন্য জমি ফাঁকা রাখার উপায় নেই। কোমরে রিভলভার নিয়ে ওরা হন্যে হয়ে ঘোরে। যে কোনও ভাবে জমিজমা হাতাতে তারা হাত পাকিয়েছে।’’ পুলিশের ওই অফিসার আরও জানাচ্ছেন, সম্পত্তি নিয়ে শরিকি বিবাদ থাকলে এদের আরও পোয়াবারো। অনেক কম দামে সেই সম্পত্তি কিনে কাগজপত্র বদলে ফেলে চড়া দামে বিক্রি করে দিয়ে মোটা মুনাফা লুটছে।’’ জমিজমার দালালি ঘিরে যে দুষ্কৃতীদের দৌরাত্ম্য বাড়ছে, সে কথা জানেন শাসক দলের নেতারা। বিধায়ক দীপেন্দু বিশ্বাস বলেন, ‘‘জমি বিক্রি নিয়ে চাপ আসছে বলে কিছু অভিযোগ পেয়েছিলাম আমরা। প্রশাসনকে নিয়ে দাঁড়িয়ে থেকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাও নেওয়া হয়েছে। আমরা নানা সময়ে শহরবাসীকে জানিয়েছি, জমি মাফিয়াদের ভয় পাবেন না। সে রকম কিছু ঘটলে আমাদের জানান। পুলিশ-প্রশাসনকে জানান।’’ পুরপ্রধান তপন সরকার বলেন, ‘‘জমির চরিত্র বদল বা বেআইনি কেনাবেচার খবর আমাদের কাছে এলে পদক্ষেপ করা হবে।’’

এ সব কথায় অবশ্য বিশেষ ভরসা পাচ্ছেন না শহরবাসী। এক বৃদ্ধ নাগরিকের কথায়, ‘‘দালালির টাকা কার হাত ঘুরে কার হাতে পৌঁছয়, কে জানে। প্রোমোটার আর দালালদের দৌরাত্ম্য তো দিন দিন বেড়েই চলেছে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Basirhat Promoter Middleman
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE