Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪

মেয়েকে বললাম, বাথরুমে লুকিয়ে থাক

হই-হই করে বেড়াতে এসে কলকাতার কাছে এমন কাণ্ড ঘটতে পারে, দুঃস্বপ্নেও ভাবিনি। বিশ্বাস করুন, টাকাকড়ি, এমনকী নিজেদের প্রাণের চিন্তাও তখন আসেনি। শুধু আমাদের মেয়ে তিন্নিকে কী ভাবে বাঁচাব সেটাই মাথায় ঘুরছিল। রড, ভোজালি, পিস্তল হাতে লোকগুলো লাফ মেরে আমাদের বারান্দায় উঠছে দেখে দরজায় ছিটকিনি লাগিয়ে দিয়েছিলাম।

কলকাতায় ফিরেও উদ্বেগ কাটেনি সংঘমিত্রাদেবীর।  —নিজস্ব চিত্র।

কলকাতায় ফিরেও উদ্বেগ কাটেনি সংঘমিত্রাদেবীর। —নিজস্ব চিত্র।

সংঘমিত্রা বসুঠাকুর (গুলিবিদ্ধ পর্যটকের স্ত্রী)
শেষ আপডেট: ৩০ মার্চ ২০১৫ ০৩:৫৬
Share: Save:

হই-হই করে বেড়াতে এসে কলকাতার কাছে এমন কাণ্ড ঘটতে পারে, দুঃস্বপ্নেও ভাবিনি। বিশ্বাস করুন, টাকাকড়ি, এমনকী নিজেদের প্রাণের চিন্তাও তখন আসেনি। শুধু আমাদের মেয়ে তিন্নিকে কী ভাবে বাঁচাব সেটাই মাথায় ঘুরছিল।

রড, ভোজালি, পিস্তল হাতে লোকগুলো লাফ মেরে আমাদের বারান্দায় উঠছে দেখে দরজায় ছিটকিনি লাগিয়ে দিয়েছিলাম।

সবে ক্লাস সেভেনে উঠেছে মেয়েটা। ঘরের আলো নিভিয়ে দিয়ে ওকে বললাম, যা চুপটি করে বাথরুমে লুকিয়ে থাক্! কোনও শব্দ যেন না হয়!

দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকে ওরা প্রথমে আমার স্বামী সুদীপ্তর ছেড়ে রাখা জিন্সের পকেট থেকে নগদ টাকার খামটা বার করে ফেলে। পুরো ২৮ হাজার টাকা। তবে ও (সুদীপ্ত) কিন্তু সেই টাকা উদ্ধারের জন্য লোকগুলোকে বাধা দিতে যায়নি।

বদমায়েসগুলো আরও কিছুর খোঁজে ঘরের ভিতরে এগোচ্ছে দেখে আমার তখন বুক কাঁপছে। আলো জ্বালিয়ে বাথরুমের ভেজানো দরজা দেখে ওরা যদি বুঝতে পারে, তিন্নি ওখানে লুকিয়ে? আজকাল, এ রাজ্যে যা ঘটে চলেছে তাতে তো বাচ্চা, বৃদ্ধা কোনও মহিলাই নিরাপদ নন। মেয়েটাকে ওরা তুলে নিয়ে গেলে কী হবে ভেবেই শরীর ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছিল। সুদীপ্তও একই কথা ভেবে একটা লোককে জাপ্টে ধরে চেঁচাতে থাকে। আর তার পরই দু-দু’টো গুলির শব্দ।

বেশ কিছু ক্ষণ সাহস হয়নি, ঘরের আলো জ্বালার। নিজেই তো দেখেছি, ঘরে ঢুকেছিল তিনটে লোক। আরও দু’জন বারান্দার নীচে পাহারা দিচ্ছিল। ওরা চলে গিয়েছে কি না, বুঝব কী করে? নীচের ঘর থেকে আমাদের সঙ্গীরা মোবাইলে ফোন করলেও কেটে দিচ্ছিলাম। কথাবার্তার শব্দ শুনে ওরা যদি ফিরে আসে!

লোকগুলো একেবারে চলে গিয়েছে বলে নিশ্চিত হওয়ার পরে আলো জ্বাললাম। দেখি, সুদীপ্ত খাটে উপুড় হয়ে পড়ে। বিছানা রক্তে ভেসে যাচ্ছে। ছ’ফুটের বেশি লম্বা শরীরটাতেও আর লড়বার শক্তি নেই।

অথচ কিছু ক্ষণ আগে অবধিও সব তো ঠিকঠাকই চলছিল। শহর থেকে মোটে সওয়া দু’ঘণ্টার পথ পেরিয়ে নদীর ধারে জঙ্গল ঘেরা অপরূপ পরিবেশ। জায়গাটায় এসে আমরা মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম! সন্ধেয় পিয়ালি নদীতে বোটিংয়ের পরে তাজা মাছ কিনে লজের ঠাকুরকে ভেজে দিতে বলেছি। বাচ্চারা দারুণ উত্তেজিত। ওদের জন্যই তো বেড়াতে যাওয়া!

তিন্নি (সুদীক্ষা) আর তার তিন জন ক্লাসফ্রেন্ড মিলিয়ে আমাদের চারটি পরিবার। ছেলেমেয়েদের পরীক্ষা শেষ হওয়ার পরে একসঙ্গে উইকএন্ড ট্যুরে বেরোনোটা আমাদের বচ্ছরকার পার্বণ। মন্দারমণি, ইটাচুনার রাজবাড়ি কত জায়গাই তো ঘুরেছি। কিন্তু এ বার যা ঘটল, তার পর পশ্চিমবঙ্গে আর কোথাও বেড়াতে যেতে পারব কি? ভাবলেই শিউরে উঠছি।

রাতে খেয়েদেয়ে শুতে যাওয়ার সময়েও মনের কোণে এক ফোঁটা আশঙ্কা ছিল না। দোতলার বারান্দা অনেকটা নিচু ঠিকই। ভাল শরীর-স্বাস্থ্যের লোক হলে লাফ দিয়েই ওঠা-নামা করতে পারবে। কিন্তু খাওয়ার ঘরেই তো তিন জন উর্দিপরা পুলিশের লোককে দেখেছি। ওঁরাও ওখানেই বসে খাচ্ছিলেন। তাই আরও বেশি নিশ্চিন্ত লাগছিল। কী করে জানব, বিপদের সময়ে পুলিশের টিকিটিরও দেখা মিলবে না!

নদীর কাছেই সরকারের ‘লিজ’ দেওয়া লজ। পাশেই নাকি পুলিশের ফাঁড়ি! অথচ রাত পৌনে দু’টো থেকে আড়াইটে ঝাড়া পৌনে এক ঘণ্টা লুঠেরারা অবাধে তাণ্ডব চালিয়ে গেল। কেউ কিচ্ছু করতে পারল না!

আমরা চারটে পরিবার, একতলা ও দোতলায় দু’টো-দু’টো ঘরে ভাগ হয়ে শুয়ে ছিলাম। দোতলায় আমাদের পাশেই দলের আর একটা পরিবার, মিহির মুখোপাধ্যায়দের ঘর। বাইরে একটা চিৎকার শুনে সাধারণ কোনও গোলমাল ভেবে আমি বারান্দার দরজা খুলে কী হচ্ছে দেখতে গিয়েছিলাম। মিহিরদের ঘরে চোর-ডাকাত কিছু ঢুকেছে বুঝেই সুদীপ্তকে হাঁক দিই আমি। ও সঙ্গে সঙ্গে উঠে চিৎকার করে লোক জড়ো করার চেষ্টা করে। আমাদের লজটার লাগোয়া আরও দু’টো ব্লক। সেখানে আরও কিছু ট্যুরিস্ট রয়েছেন। মাঝে খাওয়ার জায়গায় লজের রান্নার লোক, কর্মীদের থাকার বন্দোবস্ত। কিন্তু কেউ এগিয়ে আসেনি।

লোকগুলো লাফিয়ে পাশের বারান্দা থেকে আমাদের বারান্দায় উঠে এসেছিল। ঘরের দরজা বন্ধ করে সরে এসেছিলাম আমি। দরজা ভাঙার সময়ে শুনি, স্পষ্ট বাংলায় বলছে, ‘তোদের যম এসেছে রে...’! তখনই তিন্নিকে কী ভাবে বাঁচাব ভেবে পাগল-পাগল লাগছিল। সুদীপ্তকে রড দিয়ে কোমরে, পিঠে এলোপাথাড়ি মেরেছে ওরা। পিঠে, হাতে গুলি করেছে।

১০০ নম্বরে ডায়াল করেছিলাম, কিছুই হল না। দু’বার বেজেই ফোন কেটে গেল। কলকাতায় আমার এক দাদাকেও ফোন করেছিলাম। মিহিরবাবু একবার নীচে নেমে দরজা খুলে লোক ডাকতে গেলেন, তখনও ওরা বাইরে ঘুরঘুর করছিল। রাত তিনটে নাগাদ একজন গ্রামবাসী আমাদের সাহায্য করতে বারান্দা দিয়ে উঠে আসেন। পুলিশ আসে প্রায় সওয়া তিনটেয়। সুদীপ্তকে তখনই গ্রামীণ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়। থানায় অভিযোগ লেখালেখি মিটিয়ে কলকাতা রওনা হতে পরদিন বেলা সাড়ে দশটা বেজে গেল। শুনেছি, লজের অন্য পর্যটকেরাও এর পরে আতঙ্কে সফর বাতিল করে চলে গিয়েছেন।

সুদীপ্তর কোমরে এখনও অসহ্য যন্ত্রণা। আশা করছি, গুলি বিঁধে নেই। তবে ডাক্তারি পরীক্ষার সব রিপোর্ট না-আসা ইস্তক শান্তি পাচ্ছি না। মনে হচ্ছে না আগামী পাঁচ বছরে আর কোথাও আমরা বেড়াতে যেতে পারব! চোখ বুজলেই দেখতে পাচ্ছি, লোকগুলো তেড়িয়া ভঙ্গিতে আমাদের বারান্দায় উঠে আসছে!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE