Advertisement
০৭ মে ২০২৪

বলছি তো তেল নেই, উত্তর দিল রাতের পথ

সম্প্রতি সিঙ্গুর ও খাগরাগড়ে একই রাতে দু’টি পেট্রোল পাম্পে ডাকাতির ঘটনা ঘটিয়েছে দুষ্কৃতীদের একটি দল। রাতে নিরাপত্তার অভাবে অন্য রাস্তাতেও পেট্রোল পাম্প খুলে রাখতে ভরসা পান না মালিকেরা। পরিস্থিতি খতিয়ে দেখল আনন্দবাজার। আজ, ৩৫ নম্বর জাতীয় সড়ক যশোর রোডের চিত্র।শেষ হয়ে আসছিল তেল। শীতের রাতেও কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম প্রকাশের। সবে সবে গাড়ি কিনেছিলেন বারাসতের বাসিন্দা প্রকাশ দাস। মাঝ রাতে খবর পান, বনগাঁয় এক নিকটাত্মীয় মারা গিয়েছেন। শেষ ট্রেন বেরিয়ে গিয়েছিল বহু আগে। প্রকাশবাবু ঠিক করেন, রাস্তাঘাট তো ফাঁকাই আছে। স্টিয়ারিংয়ে আনকোরা হাত হলেও গাড়ি চালিয়ে ঠিক পৌঁছে যাবেন বনগাঁয়।

মাথা খুঁড়লেও রাতে মিলবে না পেট্রোল। বনগাঁয় নির্মাল্য প্রামাণিকের তোলা ছবি।

মাথা খুঁড়লেও রাতে মিলবে না পেট্রোল। বনগাঁয় নির্মাল্য প্রামাণিকের তোলা ছবি।

সীমান্ত মৈত্র
বনগাঁ শেষ আপডেট: ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ০২:৩৪
Share: Save:

শেষ হয়ে আসছিল তেল। শীতের রাতেও কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম প্রকাশের।

সবে সবে গাড়ি কিনেছিলেন বারাসতের বাসিন্দা প্রকাশ দাস। মাঝ রাতে খবর পান, বনগাঁয় এক নিকটাত্মীয় মারা গিয়েছেন। শেষ ট্রেন বেরিয়ে গিয়েছিল বহু আগে। প্রকাশবাবু ঠিক করেন, রাস্তাঘাট তো ফাঁকাই আছে। স্টিয়ারিংয়ে আনকোরা হাত হলেও গাড়ি চালিয়ে ঠিক পৌঁছে যাবেন বনগাঁয়।

কিন্তু এমন বিপত্তিতে পড়তে হবে ভাবেননি। গাড়িতে যা তেল ছিল, তাতে গোটা কুড়ি কিলোমিটার হেসেখেলে চলে যাওয়ার কথা। ভেবেছিলেন, রাস্তায় নিশ্চয়ই পেট্রোল পাম্প খোলা পাবেন। তেল কিনেই নিতে পারবেন। রাতের রাস্তায় গাড়ি চালানোর অভিজ্ঞতা না থাকায় সে দিন যে ভুল করেছিলেন, এখনও ভোলেননি সেই অভিজ্ঞতার কথা।

প্রকাশবাবুর কথায়, ‘‘গোটা রাস্তায় একটা পেট্রোল পাম্প খোলা পাচ্ছিলাম না। কিছুটা দূর যাওয়ার পরে ভয় ভয় করছিল। গাড়ির ট্যাঙ্ক খালি হয়ে মাঝরাস্তায় গাড়িতেই রাত কাটাতে হবে না তো! যে পাম্পেই যাচ্ছি, গলা ফাটিয়ে ডেকে যদি বা ভিতর থেকে মুখ বাড়াচ্ছিলেন কেউ, সাফ জানিয়ে দিচ্ছিলেন, পাম্প বন্ধ। এত রাতে তেল দেওয়া যাবে না।’’

শেষমেশ টহলদার পুলিশ ভ্যানের কাছে গিয়ে বিপদের কথা বলেন। পুলিশই স্থানীয় একটি গ্যারাজ খুলিয়ে কিছুটা তেলের ব্যবস্থা করে। সে যাত্রা রক্ষা পেয়েছিলেন প্রকাশ।

কিন্তু বনগাঁ থেকে মধ্যমগ্রামের মধ্যে যশোর রোডের মধ্যে রাতে পেট্রোল পাম্পগুলির বেশিরভাগ বন্ধ থাকায় এমন অভিজ্ঞতা আরও অনেকের হয়েছে।

গত কিছু দিনের মধ্যে রাজ্যের নানা প্রান্তে রাতে পেট্রোল পাম্পে ৭টি ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। শেষতম সংযোজন, হুগলির সিঙ্গুর ও বর্ধমানের খাগরাগড়ে একই রাতে একই দলের ঘটানো দু’টি ডাকাতি। যার পর থেকে নতুন করে আতঙ্ক ছড়িয়েছে পেট্রোল পাম্পের মালিক-কর্মীদের মধ্যে।

পরিস্থিতি ঠিক কেমন, তা দেখতে রাতে যশোর রো়ডে বেরিয়ে পড়া গিয়েছিল। দেখা গেল, পেট্রোল পাম্প বেশিরভাগই বন্ধ। রাস্তায় পুলিশের টহলদারি ভ্যান চোখে পড়ে না এমনটা নয়, কিন্তু তারা বেশিরভাগই ব্যস্ত থাকে পণ্যবাহী ট্রাক আটকে তোলা তোলার কাজে। নম্বর প্লেটহীন অসংখ্য ট্রাক চলছে। সে দিকেও হুঁশ নেই পুলিশের। অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে আছে রাস্তার ধারের এটিএমগুলিও।

আঁধারে ঘেরা রাতের যশোর রোড।

অতীতে ৩৫ নম্বর জাতীয় সড়ক, যশোর রোডে পেট্রোল পাম্পে ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। ট্রাক ছিনতাই হয়েছে। নিরাপত্তার ঢিলেঢালা চেহারাটাই নতুন করে দেখা গেল গভীর রাতে।

রাত ৩টে: বালুইগাছি এলাকায় দেখা গেল, রাস্তার ধারের একটি পেট্রোল পাম্পে আলো জ্বলছে। গাড়ি নিয়ে সেখানে গিয়ে উঁকিঝুঁকি দিয়ে দেখা গেল, লোহার শাটারের ভিতরে দু’জন তখনও জেগে। কথোপকথন এগোল এ ভাবে...‘‘দাদা তেল হবে নাকি?’’

কোনও উত্তর নেই।

‘‘দাদা খুব বিপদে পড়েছি, একটু তেল দিতে পারেন?’’ এ বারও কোনও উত্তর নেই। ভিতরে থাকা দুই যুবক একবার আগন্তুকদের দিকে, আর একবার গাড়ির দিকে সন্দেহের চোখে তাকিয়ে। মিনিটখানেকের নীরবতা ভেঙে উত্তর মিলল, ‘‘তেল হবে। একটু দেখেশুনে তো নিতে হবে!’’

তেল দেওয়ার ফাঁকে কথা এগোল।

‘‘কী দেখলেন বলুন তো এমন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে?’’ উত্তর মিলল, ‘‘কারা তেল চাইতে এসেছে, সেটা আমরা ভাল করে দেখে বুঝে নিই। তারপরে শাটার তোলা হয়। এর আগে রাতে দু’দু’বার পাম্পে রাতে ডাকাতি হয়েছে। তারপর থেকে একটু সতর্ক না থেকে উপায় কী!’’

জানা গেল, পাম্পে রাতে বন্দুকধারী একজন নিরাপত্তারক্ষী রাখা হয়েছে। বসেছে সিসি ক্যামেরা। কোনও গাড়ি রাতে পাম্পে ঢুকলে গাড়ির নম্বর নোট করে নেওয়া হয়।

‘‘পুলিশের উপরে ভরসা নেই নাকি?’’ মুখের ভাবভঙ্গী দেখে মনে হল, রাতবিরেতে প্রশ্নটা নেহাতই আহাম্মকের মতো হয়ে গিয়েছে। তবে জানা গেল, পুলিশ টহল দেয় ঠিকই, কিন্তু সাবধানের মার নেই!

মণ্ডলগাঁথি এলাকায় আরও একটি পাম্প বন্ধই ছিল। ডেকেও সাড়া মিলল না।

বামগাছি মোড় ছাড়িয়ে আরও একটি পেট্রোল পাম্প। সেটিও বন্ধ। জানা গেল, বেশিরভাগ পাম্পই রাত ১১টার মধ্যে বন্ধ হয়ে যায়। তারপরে মাথা খুঁড়লেও কেউ পাম্প খুলে তেল দেবে না।

চালতাবেড়িয়া মোড়ের কাছে আরও একটি পেট্রোলপাম্প। সব সুনসান সেখানে। এখান থেকেই বনগাঁর দিকে যাওয়ার পথে কার্যত কোনও আলো নেই যশোর রোডে।

হাবরা শহরে দু’টি পাম্প দেখা গেল খোলা। কেনাবেচা চলছে। তবে ধারেকাছে পুলিশের গাড়ি চোখে পড়ল না। বাগনা এলাকায় একটি পাম্পে আলো জ্বললেও বন্ধ ছিল সেটিও।

চাঁদপাড়া মণ্ডলপাড়া হয়ে বনগাঁ শহরে ঢোকার সময়ে ঘড়িতে তখন রাত ৪টে। বনগাঁ শহরে ঢোকার মুখের পাম্পটিও বন্ধ।

ট্রাক চালক বা অন্য যান চালকদের বক্তব্য, রাতে ওই সড়কে গাড়ি চালাতে রীতিমতো আতঙ্কে থাকতে হয়। কারণ নিরাপত্তা তেমন নেই। চাইলেও তেল মেলে না। পুলিশি টহলও বিশেষ চোখে পড়ে না।

যশোর রোডের ধারে এক পেট্রোল পাম্প মালিক পরদিন সকালে জানালেন, রাতে তেমন নিরাপত্তা থাকে না বলেই বাধ্য হয়ে পাম্প বন্ধ রাখতে হয়। নিজস্ব নিরাপত্তা দিয়েও সশস্ত্র ডাকাতদলের হামলা ঠেকানো মুশকিল।’’

জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার তরুণ হালদার অবশ্য জানিয়েছেন, ‘‘যশোর রোডে রাতে প্রতিটি থানার দু’টি করে পুলিশ গাড়ি রাতে টহল দেয়। এটিএম ও পেট্রোল পাম্পের দিকেও পুলিশ কড়া নজর রাখে।’’ তরুণবাবু জানিয়েছেন, ‘‘সম্প্রতি বিভিন্ন এলাকায় পেট্রোল পাম্পে ডাকাতির ঘটনার পরে যশোর রোড-সংলগ্ন থানাগুলিকে সর্তক করা হয়েছে।’’

কিন্তু সারা রাত চক্কর কেটেও তেমন পুলিশ চোখে পড়ল কোথায়?

পুলিশের এক কর্তার সাফাই, টহলদার ভ্যান সড়কে থাকেই। তবে মাঝে মধ্যে কোনও ঘটনার খবর পেয়ে টহলরত গাড়িকে আশেপাশেও যেতে হয়। সে কারণে একই সময়ে সড়কের একই জায়গায় গাড়ি না-ও থাকতে পারে।

এ তো গেল রাতের যশোর রোডের কথা। কী পরিস্থিতি টাকি রোডের?

(চলবে)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE