Advertisement
১৭ মে ২০২৪

হার না মানা লড়াইয়ে স্বপ্নপূরণ

বসিরহাটের শান্ত সুন্দর গ্রাম ধলতিথা। গ্রামের বড় অংশই পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত। বহু জ্ঞানী-গুণি মানুষের জন্ম ওই গ্রামে। ১৯৫২ সালে জন্মেছিলেন পূর্ণিমাদেবী। ছোট থেকেই পড়াশোনায় আগ্রহ ছিল। বইঅন্ত প্রাণ।

লেখাপড়ায় পূর্ণিমাদেবী। নিজস্ব চিত্র

লেখাপড়ায় পূর্ণিমাদেবী। নিজস্ব চিত্র

নির্মল বসু
বসিরহাট শেষ আপডেট: ৩১ ডিসেম্বর ২০১৭ ০১:২৫
Share: Save:

পূর্ণিমার আলোর ছটায় ম্লান হয়ে গেল বয়সের বলিরেখা।

লেখাপড়া করে উচ্চশিক্ষিত হওয়ার স্বপ্ন আর ইচ্ছা শক্তির কাছে শেষ পর্যন্ত বয়সকে হার মানিয়ে ‘মাত্র’ ৬৫ বছর বয়সে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এমএ পাস করলেন বসিরহাটের ধলতিথার পূর্ণিমা বিশ্বাস। বিএ পাস করার পঁয়তাল্লিশ বছর পরে এমএ পাস করাটা মুখের কথা ছিল না। জরুরি অস্ত্রোপচারও পিছিয়ে দিয়েছিলেন এ জন্য। ছেলের বিয়ের অনুষ্ঠানের মধ্যেই পরীক্ষায় বসেছিলেন।

বসিরহাটের শান্ত সুন্দর গ্রাম ধলতিথা। গ্রামের বড় অংশই পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত। বহু জ্ঞানী-গুণি মানুষের জন্ম ওই গ্রামে। ১৯৫২ সালে জন্মেছিলেন পূর্ণিমাদেবী। ছোট থেকেই পড়াশোনায় আগ্রহ ছিল। বইঅন্ত প্রাণ। সুযোগ-সময় পেলেই একটা বই মুখে বসে পড়তেন বরাবর।

পূর্ণিমাদেবী ধলতিথা কালীনাথ বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক স্তর পেরিয়ে ভর্তি হন বসিরহাটের হরিমোহন দালাল বালিকা বিদ্যালয়ে। ১৯৭২ সালে বসিরহাট কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অনার্স নিয়ে স্নাতক হন।

এরপরে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয় শশাঙ্ক বসু এবং অমিয়াবালা বসুর আট সন্তানের সকলের ছোট পূর্ণিমাকে। সেখানেই থেমে যায় উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন। বিয়ের পর পূর্ণিমাদেবী চলে যান হাওড়ার বালির বাদামতলার বিশ্বাস বাড়িতে।

সাত তাড়াতাড়ি বিয়ে হওয়ার পরেও কিন্তু উচ্চশিক্ষার স্বপ্নকে সরিয়ে রাখতে পারেননি ওই মহিলা। স্বামী-সন্তান সামলে শ্বশুরবাড়ির হাল ধরার পাশাপাশি সময়-সুযোগ পেলেই বই নিয়ে বসে পড়েছেন। পূর্ণিমাদেবীর স্বামী দিলীপ বিশ্বাস বিদ্যুৎ দফতরের আধিকারিক ছিলেন। অবসর নিয়েছেন। তাঁদের দুই সন্তান অরুণাভ এবং মালবিকা শিবপুর থেকে এমটেক করে প্রতিষ্ঠিত। পড়াশোনার প্রতি প্রবল আগ্রহ দেখে তাঁরা মায়ের অপূর্ণ স্বপ্নকে পূরণ করার লড়াইটা চালানোর সাহস জুগিয়েছেন। স্বামীর উৎসাহও কম ছিল না।

সে সবের ভরসায় আর নিজের স্বপ্নের প্রতি বিশ্বাস রেখে ২০১৫ সালে এমএ করার জন্য নেতাজিমুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে নাম লেখান পূর্ণিমাদেবী। সব ঠিকঠাক চলছিল।

কিন্তু সব পথ যে একেবারে সরল নয়, তার প্রমাণ মেলে প্রথম বর্ষের পরীক্ষার আগের রাতে। সে রাতে পূর্ণিমাদেবীর স্বামীর হৃদরোগে আক্রান্ত হন। পরীক্ষায় বসা হয় না পূর্ণিমাদেবীর। সেবাযত্ন করে স্বামীকে সুস্থ করে তুলে ফের নেমে পড়েন লড়াইয়ে।

এর মাঝে সন্তানদের বিয়ে, সংসারের নানা ঝক্কি, নিজের অসুস্থতা— সবই সামলেছেন পূর্ণিমা। এত চেষ্টার পরেও ফের বিপত্তি।

দ্বিতীয় বার পরীক্ষার আগের দিন চিকিৎসক জানিয়ে দেন, বড় অসুখে ভুগছেন পূর্ণিমাদেবী। অবিলম্বে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে অস্ত্রোপচার করাতে হবে। স্বপ্নপূরণের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে আর পিছোতে চাননি বৃদ্ধা। ‘এক মাস পরে হাসপাতালে ভর্তি হব’— বলে চিকিৎসককে বোঝান, এমএ পাস করাটা তাঁর নিজের জন্য কতটা জরুরি।

তাঁর চেষ্টার কথা জানতে পেরে হাওড়ার লালবাবা কলেজের শিক্ষিকরা বইপত্র দিয়ে সাহায্য করেছেন। শেষমেশ স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেছেন পূর্ণিমা। যার সবটুকু কৃতিত্ব স্বামী, ছেলেমেয়ে, পরিবারকেই দিতে চান তিনি।

পূর্ণিমাদেবী বলেন, ‘‘বই আমার সব সময়ের সঙ্গী। ধলতিথায় থাকার সময়ে বাড়িতে এসেছিলেন সমরেশ বসু, সৈয়দ মুজতবা সিরাজ, বেদউইনের মতো সাহিত্যিকেরা। তাদের সঙ্গে কথা বলে অন্য রকম ভাবে দেখতে থাকি পৃথিবীটাকে। মনে হয়, পড়াশোনা করাটা কত জরুরি।’’

তবে নিজের স্বপ্ন পূরণের এই দৌড়ে কখনও সংসারকে অবহগেলা করেননি বলে জানালেন। সংসারের সব সামলে রাত জেগে পড়াশোনা করতেন। সুযোগ পেলে আরও পড়াশোনা করতে চাই, একগাল হেসে বলেন পঁয়ষট্টির ‘তরুণী’ পূর্ণিমা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Political Science MA Basirhat
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE