পাড় ভাঙছে ভাগীরথী। দেবনগরে তোলা নিজস্ব চিত্র।
বৃষ্টির জলে নদী যত ফুলে উঠছে ততই বুক কাঁপছে দেবনগরের বাসিন্দাদের। প্রতিদিন একটু একটু করে ঘরবাড়ি তলিয়ে যেতে দেখছেন পূর্বস্থলী ২ ব্লকের মেড়তলা পঞ্চায়েতের ওই গ্রামের বাসিন্দারা। তাঁদের আশঙ্কা, দ্রুত ভাগীরথীর ভাঙন রোধে ব্যবস্থা না নেওয়া হলে গ্রামটাই নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। মেড়তলা পঞ্চায়েতের যদিও দাবি, বিষয়টি জেলা প্রশাসনের নজরে আনা হয়েছে।
গ্রামের প্রবীণেরা জানান, বহু বছর আগে ভাগীরথীর গতিপথ বদলে মেড়তলা এলাকায় চর জেগে ওঠে। নাম হয় দেবনগর। ক্রমশ জনবসতি গড়ে ওঠে, বাড়ে চাষাবাদ, ছোটখাটো দোকানপাট। তবে প্রথম থেকেই যাতায়াতের একটা সমস্যা ছিল। দোকান, বাজার, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, স্কুল, ডাকঘর-সহ নানা প্রয়োজনে গ্রাম থেকে নৌকায় ভাগীরথী পেরিয়ে মেড়তলায় আসতে হয় বাসিন্দাদের।। এরপরেও একসময় ৪০০র বেশি পরিবার ওই চরে বাস করত বলে বাসিন্দাদের দাবি। কারণ চরের উর্বর জমিতে ফসল ফলত ভাল। তবে গত দু’দশক ধরে পরিস্থিতিটা বদলেছে। প্রথমে পাড়, পরে একে একে জমি, রাস্তা, স্কুল-সহ গ্রামের বহু বাড়ি গ্রাস করেছে ভাগীরথী। একসময়ে যাঁরা চাষাবাদ করে সংসার চালাতেন, তাঁদের বেশি ভাগও জমি হারিয়ে অন্যের জমিতে খেতমজুর। কেউ কেউ আবার সব্জি বিক্রি কিংবা ভ্যান চালিয়ে দিন গুজরান করেন। স্থানীয়দের দাবি, এক সময়ে নদী ঘাট থেকে কিলোমিটার দুয়েক দূরে ছিল গ্রাম। কিন্তু বর্তমানে গ্রামের অর্ধেকেরও বেশি জমি নদীগর্ভে মুছে গিয়েছে। বসতিও পিছোতে পিছোতে ঠেকেছে চরের শেষ প্রান্তে। গ্রামের বেশির ভাগ পরিবারও হয় নদিয়া কিংবা পূর্বস্থলী ২ ব্লকের বিভিন্ন গ্রামে মাথা গুঁজেছেন। রয়ে গিয়েছেন গোটা ৫০ ঘর বাসিন্দা। তাঁদেরও বেশির ভাগেরই ঘর বেড়া অথবা পাটকাঠির। পাকা ভবন বলতে একমাত্র প্রাথমিক স্কুল। তবে এটিও নদীর পাড়ে যেভাবে ঝুলছে তাতে যে কোনও দিন ভেঙে পড়তে পারে বলে বাসিন্দাদের আশঙ্কা। গ্রামবাসীরা জানান, স্কুলটির ছাত্র কমে যাওয়ায় ধুঁকছে। গত দু’বছরে ২০-র বেশি ছাত্র হয়নি। স্কুলের ছাত্র অনন্ত মণ্ডল, বিজু গুই, রাজকুমার রাজবংশীরা জানায়, নদী যেভাবে পাড় ভাঙছে তাতে স্কুলের আয়ু হয়তো আর সপ্তাহখানেক। এরপরে খোলা ছাদের নীচে হয়তো পড়াশোনা চালাতে হবে। গ্রামবাসীদের দাবি, নদী পেরিয়ে উচ্চ বিদ্যালয়ে যেতে হয় বলে গ্রামের অনেকেই উচ্চশিক্ষায় আগ্রহ দেখায় না। এ বার প্রাথমিক স্কুলটি ভেঙে পড়লে পড়াশোনা শিকেয় উঠবে।
তবে শুধু নদীর ভাঙন নয়, বালি এবং মাটি মাফিয়াদের দৌরাত্ম্যও গ্রামের মুছে যাওয়ার কারণ বলে গ্রামবাসীদের দাবি। তাঁদের অভিযোগ, রাতের অন্ধকারে পাড়ের মাটি কেটে নৌকায় বোঝাই করে নিয়ে যায় অনেকে। ফলে ভাঙন বাড়ছে আরও। গ্রাম ছেড়ে, ভিটেমাটি ফেলেই অন্যত্র চলে যাচ্ছেন অনেকে। দেবনগরের বাসিন্দা মদন রাজবংশী, আলো রাজবংশীরা বলেন, ‘‘চোখের সামনে গোটা গ্রামটা শ্মশান হয়ে গেল। যে কয়েকঘর এখনও মাটি কামড়ে পরে রয়েছি তারা বড়জোর বছর খানেক কাটাতে পারবেন।’’ তাঁদের দাবি, প্রশাসন দ্রুত ব্যবস্থা নিলে কিছুটা ভাঙন রোধ করা যেত।
মেড়তলা পঞ্চায়েতের প্রধান ধরমেন্দ্র ঘরামিও বলেন, ‘‘গ্রামের বেশীর ভাগ অংশই চলে গিয়েছে নদীতে। যেটুকু রয়েছে ব্যবস্থা না হলে তাও তলিয়ে যাবে। জেলা প্রশাসনকে জানানো হয়েছে বিষয়টি।’’ তাঁর দাবি, শুধু দেবনগর গ্রামই নয়, এলকার কুঠুরিয়া গ্রামেও ভাঙন শুরু হয়েছে। প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, এই গ্রামটি এমনিতেই জেলা প্রশাসনের তালিকায় পিছিয়ে পড়া গ্রাম হিসাবে চিহ্নিত। স্থানীয় বিধায়ক তপন চট্টোপাধ্যায়ও বলেন, ‘‘বাঁশের খাঁচা ফেলেও ওখানে ভাঙন রোধ করা যাচ্ছে না। এটাই সমস্যা।’’ তবু গ্রাম বাঁচাতে চেষ্টা করা হবে বলে আশ্বাস দিয়েছেন তিনি।
ততদিন তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় জেগে রাত কাটানোই ভবিতব্য দেবনগরের।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy