Advertisement
১১ মে ২০২৪

জরিমানা দিতে না পেরে আত্মঘাতী, দাবি মায়ের

বাড়ির বউয়ের স্বভাবের দিকে দিকে আঙুল তুলে দশ হাজার টাকা জরিমানা করেছিল পাড়ার ক্লাবের সদস্যেরা। জরিমানা না মেটাতে পারায় গ্রাম ছাড়তে হয় দম্পতিকে।

করন্দা গ্রামের বাড়িতে ঠাকুমার সঙ্গে প্রতাপ ও প্রিয়াঙ্কা।—নিজস্ব চিত্র।

করন্দা গ্রামের বাড়িতে ঠাকুমার সঙ্গে প্রতাপ ও প্রিয়াঙ্কা।—নিজস্ব চিত্র।

সৌমেন দত্ত
মেমারি শেষ আপডেট: ১৯ মে ২০১৬ ০২:৪৮
Share: Save:

বাড়ির বউয়ের স্বভাবের দিকে দিকে আঙুল তুলে দশ হাজার টাকা জরিমানা করেছিল পাড়ার ক্লাবের সদস্যেরা। জরিমানা না মেটাতে পারায় গ্রাম ছাড়তে হয় দম্পতিকে। ফরমান ছিল, ছেলে ঘরে ফিরলেও জরিমানা না দেওয়া পর্যন্ত বউয়ের আসা মানা। মঙ্গলবার ট্রেনের সামনে ঝাঁপ দিয়ে আত্মঘাতী হন ওই দম্পতি। প্ল্যাটফর্মেই রেখে যান তিন বছরের মেয়েটিকে। অভিযোগ, গ্রামে ঢুকতে না পেরে ফিরে গিয়েই ওই কাণ্ড ঘটান তাঁরা।

পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, মেমারির করন্দা গ্রামের ওই দম্পতি কার্তিক কর্মকার ও পূজা কর্মকার মাস খানেক ধরে পালসিট স্টেশনের কাছে ভাড়া বাড়িতে থাকতেন। কলকাতায় এক ঠিকাদারের কাছে দিনমজুরি করতেন কার্তিকবাবু। তাঁদের বড় ছেলে, পাঁচ বছরের প্রতাপ ঠাকুমা লক্ষ্মীদেবীর সঙ্গে করন্দায় থাকত। আর তিন বছরের মেয়ে প্রিয়াঙ্কা থাকত বাবা-মায়ের সঙ্গে। মঙ্গলবার প্রিয়াঙ্কার সামনেই ট্রেনের সামনে ঝাঁপ দেন ওই দম্পতি। রেল পুলিশের হাওড়া বিভাগের এক কর্তা বলেন, “আমরা বিভিন্ন সূত্র থেকে জানতে পেরেছি, জরিমানার টাকা দিতে পারেনি বলে গ্রাম ছাড়তে হয়েছিল ওই দম্পতিকে। মঙ্গলবার দুপুরে ওই দম্পতি তাঁদের ছোট মেয়েকে নিয়ে গ্রামে গিয়েছিল। কিন্তু ছেলেটির মা তাঁদের জানান, জরিমানা না দিলে বউমাকে ক্লাবের ছেলেরা ঢুকতে দেবে না। তারপরেই মেয়ের চোখের সামনে ওই ঘটনাটি ঘটে।’’ তবে বর্ধমান থানায় এখনও কোনও অভিযোগ দায়ের হয়নি।

পুলিশের দাবি কার্যত স্বীকার করে নেন ওই ক্লাবের কর্তারাও। বুধবার সকালে করন্দা গ্রামে ওই দম্পতির বাড়ির দাওয়াই বসে সকলের সামনে ক্লাবের কর্তা বলাই কোঁড়া বলেন, “ভয় দেখানো হচ্ছিল।” তবে অন্য প্রশ্ন করার আগেই চলে যান তিনি। তারপরেই তাঁকে আর দেখা যায়নি। ক্লাবের অন্য সদস্যরাও মুখে কুলুপ আঁটেন।

করন্দা গ্রামের কোল পাড়ায় গিয়ে দেখা যায়, প্রতাপ ও প্রিয়াঙ্কা অঙ্গনওয়ারি কেন্দ্রে খিচুড়ি খাচ্ছে। প্রতাপ জানায়, আগের দিন থেকে পেটে কিছু পরেনি। আর প্রিয়ঙ্কা বলে, “বিস্কুট দিয়ে বাবা বসতে বলল। দেখলাম, ট্রেন এল আর মা-বাবা লাফ দিল।’’ ঠাকুমা লক্ষ্মীদেবী বলেন, “গ্রাম থেকে চলে যাওয়ার সময়ই আমার মনে কু ডেকেছিল। ওরা প্রিয়ঙ্কাকে আমার কাছে রাখতে চেয়েছিল। কিন্তু আমি মেয়েটিকে ওদের সঙ্গে জোর করে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। তারপরেও সব চলে গেল আমার।’’ তাঁর দাবি, ওই দিনই শক্তিগড়ের কাছে ছেলে-বৌমাকে নিয়ে পুজো দিতে গিয়েছিলেন তিনি। ফেরার পথে ওই দম্পতি ট্রেন থেকে ঝাঁপ দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন বলেও লক্ষ্মীদেবীর দাবি। তবে লক্ষ্মীদেবী থাকায় সে যাত্রায় বেঁচে যান। তিন জন মিলে করন্দা গ্রামে আসেন। লক্ষ্মীদেবীর দাবি, “গ্রামে ঢোকার মুখে পুকুর পাড়ে আমি ওদের বলি, কার্তিক আমার সঙ্গে গ্রামে যেতে পারবে। কিন্তু জরিমানার টাকা দিতে পারিনি বলে বৌমাকে ঢুকতে দেবে না। আমি ওই টাকা জোগাড় করে বৌমাকে নিয়ে যাব। আমার কথা শুনে ছেলে আর গ্রামে না ঢুকে বউমাকে নিয়ে চলে যায়।” তারপরেই ওই ঘটনা ঘটে।

ওই দম্পতির পরিজনদের অভিযোগ, “ক্লাবের সদস্যদের অন্যায় দাবির জন্য দুধের শিশুরা কার্যত অনাথ হয়ে গেল। তাদের জীবন থেকে বাবা-মায়ের ছায়াটুকুও চলে গেল। সারা জীবনেও কি প্রিয়ঙ্কা ওই দৃশ্য ভুলতে পারবে?” স্থানীয় নবস্থা ২ গ্রাম পঞ্চায়েতের উপপ্রধান, করন্দা গ্রামেরই বাসিন্দা অলোক গোস্বামী বলেন, “জরিমানার ঘটনা আমিও শুনেছি। এ রকম ঘটনা যাতে আর না ঘটে সে জন্য বলে দেওয়া হয়েছে। পঞ্চায়েত থেকে এর বিরুদ্ধে প্রচার করা হবে।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE