Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

জেলা ভাগের ঘোষণায় খুশি শিল্পাঞ্চল

কেউ বলছেন প্রশাসনিক বিভিন্ন কাজকর্মে সুবিধা হবে, কারও আবার আক্ষেপ এ বার থেকে আর হয়তো জেলার বৈচিত্র নিয়ে গর্ব করা যাবে না। শুক্রবার, মুখ্যমন্ত্রীর জেলা ভাগের ঘোষণার ফলে দিনভর এমনই মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেল বর্ধমান জেলার দুই প্রান্তে।

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ২৮ নভেম্বর ২০১৫ ০১:৫৪
Share: Save:

কেউ বলছেন প্রশাসনিক বিভিন্ন কাজকর্মে সুবিধা হবে, কারও আবার আক্ষেপ এ বার থেকে আর হয়তো জেলার বৈচিত্র নিয়ে গর্ব করা যাবে না। শুক্রবার, মুখ্যমন্ত্রীর জেলা ভাগের ঘোষণার ফলে দিনভর এমনই মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেল বর্ধমান জেলার দুই প্রান্তে। পালাবদলের পর ক্ষমতায় এসেই মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করেছিলেন বর্ধমান থেকে আসানসোল, দুর্গাপুর-সহ শিল্পাঞ্চলকে আলাদা জেলা করা হবে। এ দিন সন্দেশখালিতে একটি সরকারি অনুষ্ঠান থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানান, বর্ধমানকে ভাগ করে শিল্পাঞ্চল ও পশ্চিম মেদিনীপুরকে ভাগ করে ঝাড়গ্রামকে জেলা করার কাজ দ্রুত শুরু হবে।

জেলার সদর শহর বর্ধমানে। ভৌগলিক ভাবে আসানসোল, দুর্গাপুর, রানিগঞ্জ, জামুড়িয়া, অন্ডাল, পাণ্ডবেশ্বর-সহ বিভিন্ন খনি ও শিল্পাঞ্চল থেকে বর্ধমান শহরের দূরত্ব প্রায় ৬০ থেকে ১৩০ কিলোমিটার। এর জেরে বিভিন্ন প্রশাসনিক প্রয়োজনে শিল্পাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকা থেকে বর্ধমানে আসতে দীর্ঘক্ষণ সময় লেগে যায়। অনেক সময় কাজ সেরে ফেরাও যায় না বলে জানান শিল্পাঞ্চলের বাসিন্দাদের একাংশ।

মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণার পরে খুশির হাওয়া শিল্পাঞ্চলের সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে রাজনৈতিক মহলে। আসানসোল কর্পোরেশনের মেয়র জিতেন্দ্র তিওয়ারি বলেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী একের পর এক উপহার দিচ্ছেন শিল্পাঞ্চলবাসীকে। সেগুলো কাজে লাগাতে হবে।’’ দুর্গাপুরের মেয়র অপূর্ব মুখোপাধ্যায় আবার মনে করেন, এই সিদ্ধান্তের ফলে শিল্পাঞ্চলের মানুষের প্রশাসনিক বিভিন্ন কাজ করতে যাওয়ার হয়রানি অনেকাংশে কমবে। তিনি বলেন, ‘‘জেলা ছোট হলে ৫০ থেকে ৬০ কিলোমিটারের মধ্যে সমস্ত সরকারি দফতর চলে আসবে।’’ মুখ্যমন্ত্রীর জেলা ভাগের ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়েও আসানসোলের প্রাক্তন সাংসদ বংশগোপাল চৌধুরীর মন্তব্য, ‘‘বাম আমলেই প্রথম এই প্রস্তাব ওঠে। তবে দেখতে হবে, বিধানসভা নির্বাচনের পরে এই ঘোষণা যেন স্থগিত না হয়ে যায়।’’

জেলা ভাগকে কেন্দ্র করে প্রত্যাশার পারদ চড়েছে শিল্পাঞ্চলের ব্যবসায়ী মহলেও। তাঁদের আশা, নতুন শিল্পের উপযোগী পরিকাঠামো তৈরি হবে। বণিক সংগঠন ‘ফেডারেশন অফ সাউথ বেঙ্গল চেম্বার অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ’-র কার্যকরী সভাপতি রাজেন্দ্রপ্রসাদ খেতান, দুর্গাপুর চেম্বার অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি’র সভাপতি চন্দন দাসদের বক্তব্য, এর ফলে শিল্পাঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটবে। তাঁদের আশা, এর ফলে বাজারের সঙ্গে সঙ্গে বাড়বে কর্মসংস্থানও।

জেলা ভাগের ফলে শিল্পাঞ্চলের শিক্ষা মানচিত্রেও জোয়ার আসবে বলে আশা শিক্ষাবিদদের। কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সাধন চক্রবর্তী এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানান। মাইকেল মধুসূদন মেমোরিয়াল কলেজের শিক্ষক শ্রীবাস টিকাদার মনে করেন, ‘‘এর ফলে শিল্পাঞ্চলের বিভিন্ন কলেজে ভর্তির লম্বা লাইন খানিকটা হলেও কমবে। সুযোগ পাবেন শিল্পাঞ্চলের পড়ুয়ারাই।’’ এ ছাড়া বিভিন্ন সরকারি চাকরির পরীক্ষার ফর্ম তোলার জন্যও বর্ধমানে যেতে হয় শিল্পাঞ্চলের চাকরিপ্রার্থীদের। যেমন, প্রাইমারি টেট-এর ফর্ম তুলতে অনেক চাকরিপ্রার্থীকে আগের দিন বর্ধমানে যেতে হয়েছিল। শিল্পাঞ্চলের বিভিন্ন স্কুলের শিক্ষকেরা জানান, ডিআই অফিস, স্কুল সার্ভিস কমিশন, সর্বশিক্ষা মিশনের আঞ্চলিক দফতর-সহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলি বর্ধমানে রয়েছে। তাঁদের আশা, জেলা হলে সবই মিলবে নাগালের মধ্যে।

শিল্পাঞ্চলে জেলা ভাগের সিদ্ধান্তে খুশির হাওয়া বইলেও বর্ধমানের কালনা, কাটোয়ার বিভিন্ন মহলে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গিয়েছে। ব্যবসায়ীদের একাংশের মতে, জেলা ভাগের সিদ্ধান্তের জেরে কিছুটা হলেও অর্থনৈতিক ভাবে ধাক্কা খাবে কৃষিপ্রধান এলাকাগুলি। কালনার শিল্পপতি সুশীল মিশ্র যেমন বলেন, ‘‘রাজস্ব আদায়ের দিক থেকে গ্রামীণ বর্ধমানের তুলনায় শিল্পাঞ্চল অনেক এগিয়ে। এর ফলে জেলা জুড়ে উন্নয়নের ভারসাম্য বজায় রাখতে সুবিধা হতো। নতুন জেলা হলে আমাদের প্রধান চ্যালেঞ্জ রাজস্ব ঘাটতি সামলেও কী ভাবে এলাকার উন্নয়ন বজায় রাখা যাবে।’’ তবে কাটোয়া মহকুমা ব্যবসায়ী সমিতির মুখপাত্র বিদ্যুৎ কুমার নন্দীর আশা, ‘‘প্রশাসনিক দিক দিয়ে সুবিধা হবে। কাজে গতি আসবে।’’ বিভিন্ন ক্ষেত্রে নিয়োগের ক্ষেত্রে স্থানীয়রা সুযোগ পাবেন বলে আশা চিত্রশিল্পী সুমিত গোস্বামীর। যদিও বর্ধমানের বিভিন্ন এলাকার মানুষের একাংশের মতে, এর ফলে বৈচিত্র হারাবে জেলা। স্থানীয় বধূ কল্পনা বসাক যেমন বলেন, ‘‘আমার ছোটবেলা কেটেছে বরাকরে। জেলার দু’দিকের চরিত্র আলাদা। জেলা ভাগ হলে বৈচিত্র হারাব আমরা সকলেই।’’ শিক্ষক তারকেশ্বর চট্টরাজ আবার মনে করেন, বর্ধমানের গুরুত্ব কৃষি আর শিল্পাঞ্চল মিলিয়েই। জেলা ভাগ হলে তেমনটা আর থাকবে না বলে আশঙ্কা তাঁর। একই মত শিল্পী নন্দন সিংহেরও।

তবে প্রশাসনের একটি সূত্রের মতে, জেলা ভাগের প্রস্তুতি রাজ্যে পালাবদলের পরেই শুরু হয়ে যায়। তারই ফলশ্রুতিতে আসানসোল মহকুমা হাসপাতালকে জেলা হাসপাতাল হিসেবে উন্নীত করা হয়। ২০১১-র সেপ্টেম্বরে তৈরি হয় আসানসোল-দুর্গাপুর পুলিশ কমিশনারেট। আসানসোলে জেলা পরিষদের দফতরটিকেও নতুন ভাবে সাজানো হয়।

বাসিন্দাদের মতে নতুন জেলা তৈরির সলতে পাকানোর কাজটা সুরু হয়ে গিয়েছিল আগেই। এ দিন মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণায় তাতে শিলমোহর পড়ল নতুন করে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE