Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

পুলিশের টানা টহল, আতঙ্কে গ্রাম

ঘটনার পাঁচ দিন কেটে গিয়েছে, তবু আতঙ্ক কাটেনি আউশগ্রামের প্রতাপপুর গ্রামে। বাড়ির পুরুষেরা সব ঘরছাড়া, মেয়েরা কেউ কেউ রয়ে গিয়েছেন গরু, ছাগলগুলো দেখাশোনার জন্য। তবে দিনে তিন বার পুলিশের টহলে আর বুটের শব্দে উচাটন কাটছে না কিছুতেই। স্কুলগুলিতেও শিক্ষকেরা এসেছেন ঠিকই, কিন্তু পড়ুয়া মেরেকেটে তিন জন। কার্যত প্রতাপপুর পাহারা দিচ্ছেন একাধিক পুলিশ আধিকারিক ও প্রায় ৭০ জন র‌্যাফ ও পুলিশ কর্মী।

রাস্তায় শুধু পুলিশ। —নিজস্ব চিত্র।

রাস্তায় শুধু পুলিশ। —নিজস্ব চিত্র।

সৌমেন দত্ত
আউশগ্রাম শেষ আপডেট: ২৯ অগস্ট ২০১৫ ০১:২৬
Share: Save:

ঘটনার পাঁচ দিন কেটে গিয়েছে, তবু আতঙ্ক কাটেনি আউশগ্রামের প্রতাপপুর গ্রামে।

বাড়ির পুরুষেরা সব ঘরছাড়া, মেয়েরা কেউ কেউ রয়ে গিয়েছেন গরু, ছাগলগুলো দেখাশোনার জন্য। তবে দিনে তিন বার পুলিশের টহলে আর বুটের শব্দে উচাটন কাটছে না কিছুতেই। স্কুলগুলিতেও শিক্ষকেরা এসেছেন ঠিকই, কিন্তু পড়ুয়া মেরেকেটে তিন জন। কার্যত প্রতাপপুর পাহারা দিচ্ছেন একাধিক পুলিশ আধিকারিক ও প্রায় ৭০ জন র‌্যাফ ও পুলিশ কর্মী।

চারিদিক জঙ্গলে ঘেরা আউশগ্রামের ভাল্কি পঞ্চায়েতের প্রতাপপুর গ্রাম। গত সোমবার সিপিএম-তৃণমূল সংঘর্ষে ১৬ জন আহত হন এখানে। এর আগেও সিপিএমের হামলার অভিযোগ তুলে গ্রাম ছেড়ে জঙ্গলে আশ্রয় নিয়েছিলেন তৃণমূলের লোকেরা। পুলিশ ক্যাম্প হওয়ার পরে অবশ্য ফিরে আসেন তাঁরা। কিন্তু পুলিশ ক্যাম্প থাকা সত্ত্বেও আবারও সংঘর্ষ বাধে। তৃণমূলের দলীয় দফতর পোড়ানোর অভিযোগ ওঠে সিপিএমের বিরুদ্ধে। ঘটনার পরে জেলা পুলিশ সুপার কুণাল অগ্রবাল গ্রামে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন। তারপর থেকেই পুলিশই কার্যত দখল নিয়েছে গ্রামের। কয়েকজন মহিলা-সহ ১২ জন গ্রেফতারও হয়েছেন।

গ্রামের বোড়ো পাড়া মোড়ে গিয়ে দেখা গিয়েছে সিপিএমের বেশ কয়েকটা পতাকা উড়ছে। তৃণমূলের দলীয় দফতরেও অগ্নি সংযোগের চিহ্ন স্পষ্ট। এসডিপিও (কাটোয়া) তন্ময় সরকারের নেতৃত্বে পুলিশ টহল চলছে। গ্রামের মাধ্যমিক স্কুলে, বোড়ো পাড়া মোড়ের একটি ক্লাবে ও স্থানীয় নির্মীয়মাণ একটি বাড়িতে পুলিশ ক্যাম্প রয়েছে। গ্রামে ঢোকার মুখে বাবুরবাগ প্রাথমিক স্কুলে গিয়ে দেখা গেল মেরেকেটে তিন ছাত্র হাজির হয়েছে। প্রধান শিক্ষক নীলকুমার পাল বলেন, “সোমবার থেকে স্কুলে কোনও পড়ুয়ার দেখা নেই। আজ তাও তিন জন এসেছে!” পাশেই রয়েছে প্রতাপপুর ডাঙাপাড়া উচ্চবিদ্যালয়। সেখানে আবার স্কুলের ঘরগুলি চলে গিয়েছে পুলিশের দখলে। একটি ঘরে বসে রয়েছেন বেশ কয়েকজন শিক্ষক। তাঁরাই জানালেন, মঙ্গলবার থেকে স্কুলমুখী হয়নি কোনও পড়ুয়া। তার উপর আবার স্কুলে পুলিশ ক্যাম্প হয়েছে। তফসিলি উপজাতি হোস্টেলের ঘরগুলিও তালাবন্ধ পড়ে রয়েছে।

বারবার রাজনৈতিক সংঘর্ষ, পুলিশের ধরপাকড়ের জেরে পুরুষেরা তো বটেই মহিলারাও ঘরদোর ছেড়ে পালিয়েছেন। পুলিশের টানা টহলদারিতে নিশ্চিন্তি কেটে গিয়েছে গ্রামের। মিনা বিবি, ফিরোজা বেগমেরা বলেন, “আমরা একাই বাড়িতে রয়েছি। গরু-মুরগিগুলোকে ছেড়ে যেতে পারছি না। তবে রাতের বেলা পুলিশের ভারি বুটের শব্দে আতঙ্ক কাটছে না।’’ পুলিশ অবশ্য বাড়িতে তল্লাশি চালায়নি বলে জানিয়েছেন তাঁরা। ‘আতঙ্কে’র আবহাওয়ার মধ্যেও গ্রামে রয়েছেন আবেদ রহমান। তাঁর কথায়, “গোটা গ্রামে হাতে গোনা কয়েকজন পুরুষ-মহিলা রয়েছেন। আমি বেশ কয়েকটা পরিবারের গবাদি পশুর দেখাশোনা করছি।” কিছুটা দূরে গরুকে খ়ড় দিচ্ছিলেন গ্রামের শেখ আব্বাসউদ্দিন, আর এক প্রবীণ সোহেব হোসেন। তাঁরা আবার বলেন, ‘‘তিন দিন গবাদি পশুর মুখে কিছু পড়ে নি। লুকিয়ে খাবার দিতে এসেছি। আবার কুটুম বাড়ি ফিরে যাব।” ‘আশপাশের জঙ্গলেও রাত কাটাচ্ছেন অনেকে। তাঁদেরই এক জন রূপালি বিবি বলেন, “তিন ও পাঁচ বছরের শিশুকে নিয়ে সোমবার থেকে জঙ্গলে রয়েছি। বাড়ি ফিরব বলে ভাবছি।”

তবে গ্রামের শেষ প্রান্তের বাড়ি থেকে বেরিয়ে এক বধূ পুলিশের ভূমিকার প্রশংসাই করলেন। তিনি বলেন, “পুলিশ তো আমাদের শান্তিতে রাখার জন্যই চেষ্টা চালাচ্ছে। তাহলে পুলিশের ভয়ে গ্রাম ছাড়ব কেন?” জেলার এক পুলিশ কর্তা বলেন, “পরিস্থিতি আর একটু স্বাভাবিক হয়ে গেলেই সর্বদলীয় বৈঠক ডেকে গ্রামে যাতে শান্তি ফিরে আসে তার ব্যবস্থা করব। যাঁরা অভিযুক্ত নন, তাঁরা গ্রামে ফিরে আসুন— এটা আমরাও চাই।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE