Advertisement
০৭ মে ২০২৪

বেহাল পড়ে সমাজবাড়ি, বিক্রির উদ্যোগ

বারবার আবেদন সত্ত্বেও প্রশাসনের তরফে সংরক্ষণের প্রতিশ্রুতি মেলেনি। ফলে খানিকটা বাধ্য হয়েই কালনা শহরের প্রাচীন পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন সমাজবাড়ির জমি বিক্রি করতে উদ্যোগী হয়েছে মালিকপক্ষ। তাঁদের দাবি, বাড়ির ভিতরের ৩৫ কাঠা জমি বিক্রির জন্য ইতিমধ্যেই চিহ্নিত করা হয়েছে। বেশ কয়েকটি প্লটে ভাগ করে জমি বিক্রির পরিকল্পনা করা হয়েছে। ইতিমধ্যে এক ব্যক্তির কাছ থেকে কাঠা ছয়েক জমির বায়না নেওয়া হয়ে গিয়েছে বলেও তাঁদের দাবি।

এভাবেই পড়ে রয়েছে জরাজীর্ণ সমাজবাড়ি। —নিজস্ব চিত্র।

এভাবেই পড়ে রয়েছে জরাজীর্ণ সমাজবাড়ি। —নিজস্ব চিত্র।

কেদারনাথ ভট্টাচার্য
কালনা শেষ আপডেট: ২৩ এপ্রিল ২০১৪ ০১:২১
Share: Save:

বারবার আবেদন সত্ত্বেও প্রশাসনের তরফে সংরক্ষণের প্রতিশ্রুতি মেলেনি। ফলে খানিকটা বাধ্য হয়েই কালনা শহরের প্রাচীন পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন সমাজবাড়ির জমি বিক্রি করতে উদ্যোগী হয়েছে মালিকপক্ষ। তাঁদের দাবি, বাড়ির ভিতরের ৩৫ কাঠা জমি বিক্রির জন্য ইতিমধ্যেই চিহ্নিত করা হয়েছে। বেশ কয়েকটি প্লটে ভাগ করে জমি বিক্রির পরিকল্পনা করা হয়েছে। ইতিমধ্যে এক ব্যক্তির কাছ থেকে কাঠা ছয়েক জমির বায়না নেওয়া হয়ে গিয়েছে বলেও তাঁদের দাবি।

এ রাজ্যে অসংরক্ষিত পুরাকীর্তিগুলির মধ্যে একটি হল কালনার সমাজবাড়ি। ব্যক্তিগত মালিকানায় থাকা বর্ধমান রাজ পরিবারের ওই নিদর্শনটি বহু বছর ধরেই অবহেলায় পড়ে রয়েছে বলে অভিযোগ। এক একর ৪৩ শতক জমির উপর তৈরি সমাজবাড়ির ভিতর রয়েছে দুটি মন্দির। স্থানীয়দের দাবি, প্রাচীন ওই মন্দিরের গায়ে লম্বা ফাটল দেখা দিয়েছে। চাঙর খসে পড়ছে। রোদ-জল-বৃষ্টিতে মন্দিরের গায়ের বহু কারুকার্য নষ্টও হয়ে গিয়েছে। এমনকী বহু বছর সংস্কার না হওয়ায় আগাছায় ঢেকে গিয়েছে মন্দিরের চূড়া। আশপাশের এলাকাতেও বনজঙ্গল গজিয়ে গিয়েছে। সমাজবাড়ির মধ্যেই বসবাস করেন মালিকপক্ষ বিশ্বাস পরিবারের কয়েকজন সদস্য। তাঁদের দাবি, বিশাল এলাকায় কোনও নিরাপত্তারক্ষী নেই। ইতিমধ্যেই মন্দিরের কাঠের দরজা, মন্দির চূড়ার লোহা-সহ নানা জিনিস চুরি গিয়েছে। তাঁদের অভিযোগ, প্রশাসনের কাছে বারবার অধিগ্রহণের আবেদন জানিয়েও লাভ হয়নি। তাঁদের আশঙ্কা, মন্দিরের যা হাল কোন দিন সবটা না হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ে।

পশ্চিম ভারতীয় রীতি অনুযায়ী সংস্কারের পরে পাথর বা ধাতুর পাত্রে চিতাভস্ম-সহ মৃতের কিছু প্রিয় জিনিস রেখে তার উপর স্মৃতিমন্দির তৈরি করা হয়। একেই বলে সমাজবাড়ি। কাটোয়ার দাঁইহাটে কীর্তিচাঁদের সমাজবাড়ি রয়েছে। ১৮৩০ সালে বর্ধমানের রাজা মহতাব চাঁদ কালনা শহরে এই সমাজবাড়ি তৈরি করেন। এখানে তেহচাঁদ ও তাঁর স্ত্রী কমলকুমারীর স্মৃতিমন্দির রয়েছে। প্রথমটি বিরল সতেরো চূড়া মন্দির আর দ্বিতীয়টি ন’চূড়ার মন্দির। দাঁইহাটের সমাজবাড়ি ইতিমধ্যেই পশ্চিমবঙ্গ হেরিটেজ কমিশন সংরক্ষিত পুরাকীর্তির মর্যাদা পেয়েছে। কিন্তু কালনার ক্ষেত্রে তা না হওয়ায় দীর্ঘদিন ধরেই ক্ষোভ রয়েছে বাসিন্দাদের। এ ছাড়া ১৯৬৬ সালে বর্ধমান রাজার এস্টেট থেকে দীর্ঘমেয়াদি লিজে সমাজবাড়ি দেখভালের দায়িত্ব পান নবদ্বীপের তেঘড়িপাড়ার অবনী বিশ্বাস। প্রথম দিকে রাজ এস্টেটকে কর দিলেও পরবর্তীতে সরকারের কাছে সমাজবাড়ি নিজেদের দায়িত্বে নেওয়ার আবেদন জানান তাঁরা। আবেদন মঞ্জুরও হয়। তবে সমস্যা দেখা দেয় ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতরের নথি নিয়ে। সেখানে বাড়িটিকে সমাধিস্থল বলে উল্লেখ করা হয়েছে। পরে নিজেদের অধিকার বজায় রাখতে আদালতের দ্বারস্থ হয় বিশ্বাস পরিবার। আদালতের রায়ও তাদের পক্ষেই যায়। এর পরেই বাড়ি বিক্রির জন্য তৎপর হয় মালিক পক্ষ। তাদের দাবি, বছর দু’য়েক আগে থেকেই বিক্রির চেষ্টা শুরু হয়। সমাজবাড়ির সঙ্গে বহু মানুষের আবেগ জড়িয়ে থাকায় সরকারকে এটি নিয়ে নেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়। মহকুমাশাসকের কার্যালয়ে কয়েকবার বৈঠকও হয়। তবে কোনও সুরাহা না হওয়ায় বেসরকারি ভাবে বিক্রির চেষ্টা শুরু হয়। কালনা শহরেরই এক ব্যবসায়ী সুব্রত পাল বাড়িটি কিনে বেসরকারি কলেজ ও লজ গড়ার প্রস্তাব দেন। বায়না বাবদ বেশ কয়েক লক্ষ টাকা মালিকপক্ষকে দিয়েও দেন তিনি। তবে কাজে নামতেই সুব্রতবাবু বাধা পান। বাড়িটিকে কোনও ভাবেই ধ্বংস না করার দাবিতে সরব হন এলাকারই কয়েকজন। সুব্রতবাবুও পিছিয়ে যান। মালিকপক্ষের তরফে মৃত্যুঞ্জয় মুখোপাধ্যায় জানান, বর্তমানে নয় শরিক রয়েছে। সুব্রতবাবু যে টাকা দিয়েছিলেন তা শরিকদের মধ্যে ভাগও হয়ে দিয়েছে। ফলে, সুব্রতবাবু পিছিয়ে গেলেও বায়নার টাকা তাঁকে ফেরত দেওয়া যায়নি। তাই তাঁকে টাকা ফেরত দিতে নিজেরাই বাড়ির ভেতর কিছুটা জমি চিহ্নিত করে বিক্রির উদ্যোগ করেছেন। মৃত্যুঞ্জয়বাবু বলেন, “আমরা যে ৩৫ কাঠা চিহ্নিত করেছি তার মধ্যে সমাধি মন্দিরদুটি নেই। আমরা ওই স্থাপত্য সরকারি ভাবে সংরক্ষণের চেষ্টাও করেছি। তবে এখনও কোনও উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। শরিকদের দাবি, বাড়িটিকে ঘিরে বেআইনি অধিগ্রহণ বাড়ছে। দরজা, জানালা-সহ নানা জিনস চুরিও হচ্ছে। তাছাড়া দেখভালের অভাবে মন্দিরের নানা অংশও ভেঙে পড়ছে।

মাস আটেক আগে সমাজবাড়ি বাঁচাতে সরব হয়েচিলেন পুরপ্রধান তথা কালনার বিধায়ক বিশ্বজিৎ কুণ্ডু। তিনি বলেন, “পুরাতত্ব বিভাগকে বিষয়টি জানানো হয়েছে। কলকাতায় গেলে খোঁজ নেব।” কালনার মহকুমাশাসক সব্যসাচী ঘোষ জানান, সমাজবাড়িটিকে ঘিরে বহু মানুষের আবেগ জড়িত। ফাইল এনে দেখা হচ্ছে, বিষয়টি কোন জায়গায় রয়েছে। প্রয়োজনে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নজরে আনা হবে বিষয়টি।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

kedarnath bhattacharya kalna samajbari
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE