সিটি সেন্টারে খাঁ খাঁ করছে শপিং মল। —নিজস্ব চিত্র।
এক দশকও হয়নি।
কলকাতা থেকে উত্তরে তাকালে মানচিত্র জুড়ে যে ফুটিফুটি আলো, সেখানে হঠাৎই ঝলমল করে উঠেছিল দ্রুত বদলে যেতে থাকা এক শহর। তার নাম দুর্গাপুর।
২০০৫-এর এপ্রিলে কলকাতার বাইরে রাজ্যের যে শহরটিতে প্রথম পা রাখে ‘বিগ বাজার’, সে-ও ইস্পাতনগরী ঘেঁষে গড়ে ওঠা নয়াবসতে। বদলে যাওয়ার সেই শুরু। পরের বছরেই খুলে যায় প্রথম মাল্টিপ্লেক্স ‘৮৯ সিনেমাস’, যা পরে নিয়ে নেয় ‘আইনক্স’। আসানসোল, রানিগঞ্জ, অন্ডাল, পানাগড়, রাজবাঁধ উজিয়ে মানুষ সেখানে সিনেমা দেখতে আসতেন।
বাজার গরম দেখে ২০১২ সালে জাতীয় সড়কের পাশে এক শপিং মলে ‘বায়োস্কোপ’ নামে আর একটি নতুন মাল্টিপ্লেক্স চালু করে কলকাতার ‘প্রিয়া এন্টারটেনমেন্ট’। পরের কলকাতার সংস্থা আরতি বেনাচিতির একটি শপিং মলে আরও একটি মাল্টিপ্লেক্স খোলে। ইতিমধ্যে শহরে গড়ে উঠেছে চারটি শপিং মল, একাধিক তারকা হোটেল। বেশির ভাগ নামী-দামি ব্র্যান্ডের জিনিস চাইলেই হাতের কাছে মেলে।
দেখতে-দেখতে নামী রেস্তোঁরা, খাবারের দোকান, নাম করা ফ্যাশন সংস্থার শো-রুম খুলে যায়। বদলে যেতে থাকে দুর্গাপুরবাসীর লাইফস্টাইল। যে তরুণ-তরুণীরা এত দিন কুমারমঙ্গলম পার্কে প্রেম করতে যেতেন, তাঁরা হাঁটা দেন শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত মলের দিকে। পারিবারিক উৎসবে-পরবে যাঁরা বড়জোর পাড়ার রেস্তোঁরায় চাউমিন খেতে যেতেন, তাঁরাই টিভি বা পত্রপত্রিকায় দেখে আসা ঝলমলে রেস্তোরাঁয়। এত দিন কলকাতা ঘুরে আসা আত্মীয়-বন্ধুরা বড় গলায় ফ্যাশনদুরস্ত শো-রুমের গল্প শোনাতেন। সেই সবই চোখের সামনে পেয়ে উঁকিঝুঁকি শুরু হয়ে গেল। সালোয়ার-কামিজ পিছিয়ে পড়ল, তরুণীরা অভ্যস্ত হয়ে উঠতে লাগলেন জিনস-টপে। ফ্যাশন সংস্থার শো-রুমে ভিড় জমাতে লাগলেন পুরুষেরাও।
সিটি সেন্টারে একটি টেলি পরিষেবা সংস্থার অফিসের কর্মী মিমি দত্তচৌধুরীর বাপের বাড়ি কলকাতার লেক গার্ডেনসে। তিনি জানান, ২০০৫-এর গোড়ার দিকে এই শহরে আসা ইস্তক শুধু অপেক্ষায় থাকতেন, কবে কলকাতায় ফিরবেন। তাঁ কথায়, “পরের দিকে কিন্তু ব্যাপারটা পাল্টে গেল। কলকাতার মতো না হোক, দুর্গাপুর কিন্তু দ্রুত আধুনিক হয়ে উঠছিল। বর্ষশেষ বা বর্ষবরণের পার্টি, এমনকী রেন ডান্সেও অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছিলেন শহরবাসী।” দুর্গাপুরের একটি বেসরকারি স্কুলের শিক্ষিকা ঋদ্ধিমা মুখোপাধ্যায় বলেন, “দুর্গাপুর যখন বদলাচ্ছে তখন আমরা কলেজে পড়তাম। শহরের সেই বেড়ে ওঠা আমরা চেটেপুটে উপভোগ করেছি।”
কিন্তু সবই একটা সময় পর্যন্ত। গত তিন-চার বছর ধরে ছবিটা উজ্জ্বল হওয়ার বদলে ক্রমশ মলিন হয়েছে।
কিছু দিন আগেও যে দোকানে খদ্দেরের ভিড় উপচে পড়ত, সেখানে ভিড় পাতলা হচ্ছে। ক্রেতাদের পকেটে যে টান রয়েছে, তা সবচেয়ে বেশি স্পষ্ট দামি মোবাইল ফোনের বাজার পড়ে যাওয়ায়। বেনাচিতির একটি মোবাইল দোকানের পুরনো কর্মী সত্যজিৎ চক্রবর্তীর কথায়, “কী যে হল, বুঝতে পারছি না! আগে তো খদ্দেরদের অধিকাংশ দোকানে এসেই কত দামি মোবাইল চান সেটা জাহির করতেন। আর এখন কী ভাবে কম পয়সায় মোবাইল কেনা যায়, তারই হিড়িক চলছে।” সিটি সেন্টারের একটি শপিং মলের এক মোবাইল ফোন ব্যবসায়ীরও আক্ষেপ, “দামি স্মার্ট ফোনের বিক্রি দিন-দিন কমছে। আগের মতো পরিস্থিতি আর নেই।”
২০০৭ সালে ক্ষুদিরাম সরণির একটি শপিং মলে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন এক ফ্যাশন ডিজাইনারের শাড়ির শো-রুম খোলা হয়েছিল। তাদের নিজেদের হিসেবেই, উদ্বোধনের দিন কয়েক ঘন্টার মধ্যে ২৫ লক্ষ টাকা শাড়ি বিক্রি হয়ে যায়। তার মধ্যে লক্ষাধিক টাকা দামের শাড়ি, দেড় লক্ষ টাকার লেহেঙ্গা-চোলিও ছিল। বিক্রির বার্ষিক লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ কোটি টাকার উপরে। তা তো পূরণ হয়ইনি। উল্টে টানা লোকসানে চলার পরে মাস ছয়েক হল সেই শো-রুম উঠে গিয়েছে। শো-রুমের এক প্রাক্তন কর্তা বলেন, “বছর তিনেক ধরে পরিস্থিতি খুবই খারাপ হয়ে গিয়েছিল। সে কারণেই শেষমেশ শো-রুম বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিতে হয়।”
বন্ধ মাল্টিপ্লেক্স।
বাড়ি ভাড়া দেওয়ার বিজ্ঞাপন।
শপিং মলগুলিতে খোঁজখবর নিয়ে জানা গিয়েছে, হাতে গোনা দু’একটি দোকান ছাড়া বাকিগুলিতে ভিড় নেই। জাতীয় সড়কের ধারের শপিং মলটিতে বেশ কিছু দোকান নিয়মিত ভাবে তালাবন্ধ থাকছে। একটি দোকানের কর্মীর খেদ, “পরিস্থিতি এমনই যে বিদ্যুৎ বিল বাঁচাতে দুপুরে দোকানের এসি বন্ধ রাখছেন অনেকে। ক্রেতারা এলে এসি চালিয়ে দেওয়া হয়।” বিভিন্ন শপিং মল থেকে ইতিমধ্যেই বিদায় নিয়েছে বেশ কিছু আন্তর্জাতিক মানের ব্র্যান্ড। এর মধ্যে শহরের প্রথম মাল্টিপ্লেক্সটি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ধোঁয়াশা আরও বেড়েছে। সেটির কর্তারা অবশ্য জানিয়েছেন, শপিং মলটির হাতবদল হবে। তাই আপাতত কিছু দিন বন্ধ থাকবে। তবে অন্য একটি মাল্টিপ্লেক্সের কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, দর্শকসংখ্যা আগের থেকে অনেকখানি কমে গিয়েছে। তার প্রভাব পড়ছে মাল্টিপ্লেক্স ব্যবসায়।
বছর দুয়েক আগেও দুর্গাপুর শহরের সিটি সেন্টার, বিধাননগরের মতো তুলনামূলক সম্পন্ন এলাকায় বাড়ি ভাড়া পাওয়া ছিল বড় সমস্যা। বাড়ি খুঁজে পেলেও ভাড়া এতই বেশি ছিল যে অনেকেরই তা সাধ্যে কুলোত না। বেশ কিছু বেসরকারি অর্থলগ্নি সংস্থা এবং রিয়েল এস্টেট সংস্থা চড়া ভাড়ায় বাড়ি ভাড়া নিয়ে অফিস চালাত। সারদা কাণ্ডের পরে পরিস্থিতি পাল্টে গিয়েছে। বিধাননগরে একটি সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতালের পাশে ইমন কল্যাণ সরণিতে বিশাল বাড়ি অবসরপ্রাপ্ত ব্যাঙ্ক কর্মী কানাই ভৌমিকের। তিনি হতাশ “এক বছর ধরে বাড়ি ফাঁকা পড়ে আছে। কোনও সংস্থা আসছে না।” সিটি সেন্টার এলাকাতেও ‘বাড়ি ভাড়া দেওয়া হবে’ বলে বোর্ড টাঙানো বাড়ি নজরে আসছে ঘন ঘন।
২০০৭ সালে দুর্গাপুর পুরসভার গড়া একটি শপিং মল উদ্বোধনে এসে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য দাবি করেছিলেন, তার আগে তিন বছরে এই শিল্পাঞ্চলে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ হয়েছে। তাই ব্র্যান্ডেড সংস্থাগুলির পছন্দের সেরা গন্তব্য হয়ে উঠেছে দুর্গাপুর। আসলে নয়ের দশকের মাঝামাঝি ডিএসপি-র ব্যাপক আধুনিকীকরণের সঙ্গেই একের পর এক স্পঞ্জ আয়রন, পিগ আয়রন, সিমেন্ট কারখানা গড়ে উঠেছিল। এক ঝাঁক বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ এবং ম্যানেজমেন্ট ইনস্টিটিউটও গড়ে ওঠে। এখন সেই সব কলেজগুলিতে আসন ফাঁকা পড়ে থাকছে। যেন ঝোড়োগতিতে ছুটতে-ছুটতে আচমকা ব্রেক কষেছে দুরন্ত।
ঋদ্ধিমার মতো নবীন প্রজন্মের অনেকেরই গলায় ঝরে পড়ছে আশঙ্কা “পরিস্থিতি দেখে বেশ ভয় করছে। আবার সব আগের মতো হয়ে যাবে না তো?”
কিন্তু হঠাৎ কী হল দুর্গাপুরের? পকেটে কেন টান?
(চলবে)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy