Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

শেষের ঘণ্টা বাজতেই বেড়েছে ভিড়

আর এক রাত। তারপরেই ইতিহাস হয়ে যাবে কাটোয়া-বলগোনা ন্যারোগেজ লাইন। রবিবার, শেষবারের মতো ও পথে চলবে ছোটরেল। তার আগে গত কয়েকদিন ধরেই ওই রেলের সওয়ারি হতে ভিড় জমাচ্ছেন বহু মানুষ। কাটোয়া শহর তো বটেই, কলকাতা থেকেও কাজের ফাঁকে এসে ছোটরেলে চড়ার শখ মিটিয়ে নিচ্ছেন অনেকে। স্মৃতি রোমন্থন করছেন কর্মীরা, মুহুর্মুহু ফ্ল্যাশ জ্বলছে মোবাইলেরও। রেলের এক কর্মী তো কাটোয়া স্টেশনে দাঁড়িয়ে বলেই ফেললেন, “এই ক’দিনে এত মানুষ যাত্রী হয়েছেন যে টিকিট বিক্রি অনেকটাই বেড়ে গিয়েছে। রবিবার যাত্রীদের ঠাঁই দেওয়াই কঠিন হবে।”

স্টিম ইঞ্জিন চালুর দিনে ট্রেনের মাথায় চড়েছিল লোক।

স্টিম ইঞ্জিন চালুর দিনে ট্রেনের মাথায় চড়েছিল লোক।

সৌমেন দত্ত
কাটোয়া শেষ আপডেট: ২৯ নভেম্বর ২০১৪ ০৩:০৮
Share: Save:

আর এক রাত। তারপরেই ইতিহাস হয়ে যাবে কাটোয়া-বলগোনা ন্যারোগেজ লাইন। রবিবার, শেষবারের মতো ও পথে চলবে ছোটরেল।

তার আগে গত কয়েকদিন ধরেই ওই রেলের সওয়ারি হতে ভিড় জমাচ্ছেন বহু মানুষ। কাটোয়া শহর তো বটেই, কলকাতা থেকেও কাজের ফাঁকে এসে ছোটরেলে চড়ার শখ মিটিয়ে নিচ্ছেন অনেকে। স্মৃতি রোমন্থন করছেন কর্মীরা, মুহুর্মুহু ফ্ল্যাশ জ্বলছে মোবাইলেরও। রেলের এক কর্মী তো কাটোয়া স্টেশনে দাঁড়িয়ে বলেই ফেললেন, “এই ক’দিনে এত মানুষ যাত্রী হয়েছেন যে টিকিট বিক্রি অনেকটাই বেড়ে গিয়েছে। রবিবার যাত্রীদের ঠাঁই দেওয়াই কঠিন হবে।”

শেষদিনেও কাটোয়া থেকে বলগোনা, ২৭ কিলোমিটার রাস্তায় চার জোড়া ট্রেন যাতায়াত করবে। সাধারণত ওই পথ যেতে প্রায় পৌনে দু’ঘন্টা সময় লাগে ছোটরেলের। তবে রবিবার নানা স্টেশনে সংবর্ধনা নিয়ে সঠিক সময়ে যাত্রা যে শেষ করা যাবে না, তাতে একপ্রকার নিশ্চিত রেলের কর্তারা। কাটোয়া রেলওয়ে কর্মচারীদের পক্ষে বিশ্বজিৎ দে বলেন, “যাত্রী সমিতি-সহ বিভিন্ন সংগঠনের সাহায্য নিয়ে আমরা কাটোয়া থেকে বলগোনা পর্যন্ত যাত্রাপথে ট্রেনের কামরায় ও বিভিন্ন স্টেশনে নানারকম অনুষ্ঠান করব বলে ঠিক করেছি।”

১৯১৫-র ১ ডিসেম্বর এই রেলপথটি চালু হয়। তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার এই রেলপথের জন্য বিনামূল্যে জমি দান করেন লন্ডনের ম্যাকলিওড ও রাসেল কোম্পানিকে। ওই কোম্পানি ‘ম্যকলিওড লাইট রেলওয়েজ’ নাম দিয়ে ট্রেন চালাতে শুরু করে ন্যারোগেজ লাইনে। চার জোড়া ট্রেন দিয়ে যাত্রা শুরু হয়। সেই সময় ছোট ট্রেনের ইঞ্জিনগুলি কোম্পানির বড় কর্তাদের নামে রাখা হয়েছিল। যেমন, চার্লস নরম্যান ম্যাকলয়েড, এস সি ঘোষ। পরে অবশ্য চার থেকে বেড়ে ছ’জোড়া ট্রেন চালানোও হতো একসময়। ৮০-র দশক পর্যন্ত আলাদা আলাদা প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণিও ছিল ওই রেলে। ছোট রেল নিয়ে গবেষনা করেছেন চন্দননগরের বাসিন্দা সৌরশঙ্খ মাজি। তিনি বলেন, “অর্থনৈতিক কারণে ম্যকলিওড কোম্পানি ন্যারোগেজ (আড়াই ফুট) লাইন তৈরি করে। বিনামূল্যে জমি দেওয়ার জন্য ব্রিটিশ সরকার অবশ্য রেলভাড়া ঘোষণা করত।” তবে রেলপথটি লাভজনক হবে না ভেবে ব্রিটিশ সরকার ব্রডগেজ করার পরিকল্পনা নেয়নি। পরে ম্যাকলিওড কোম্পানি বা ভারতীয় রেলও ওই লাইন থেকে লাভের মুখ দেখেনি। ১৯৬৬ সালে রেলপথটি অধিগ্রহণ করে ভারতীয় রেল।

এখন শেষবারের ছোটরেলে চড়তেও জমেছে ভিড়। ছবি: অসিত বন্দ্যোপাধ্যায়।

রেলের পরিভাষায় বর্ধমান থেকে কাটোয়া পর্যন্ত বিস্তৃত ওই পথের নাম ছিল ‘বি কে লাইন’। কিন্তু নিত্যযাত্রীরা বিদ্রুপ করে ডাকত ‘বড় কষ্টের লাইন’। ৫৭ কিলোমিটারের রেলপথে একসময় ৩০ কিলোমিটার বেগে ট্রেন চললেও সময়ের সঙ্গে দেশলাইয়ের খোপের মতো চার কামরার ওই ট্রেনের গুরুত্ব যাত্রীদের কাছে কমতে থাকে। তার মধ্যেই ১৯৯৫ সালের মার্চে স্টিম ইঞ্জিনের বদলে ডিজেল ইঞ্জিন চালু হয়। ২০০০ সালের বন্যার পর ‘দুর্বল ট্র্যাকে’র কারণে ট্রেনের গতিবেগ কমে দাঁড়ায় ঘন্টায় ১৫ কিলোমিটার। অর্থাৎ বর্ধমান থেকে কাটোয়া, ৫৩ কিলোমিটার পথ যেতে সময় লাগত সাড়ে তিন ঘন্টা। ২০০৭ সালে কাটোয়াতে প্রস্তাবিত তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রকে সামনে রেখে ওই লাইনটিকে ব্রডগেজ করার জন্য বিগত বাম সরকার ও রেলের মধ্যে চুক্তি হয়। ঠিক হয়, দু’পক্ষই অর্ধেক করে খরচ বহন করবেন। ওই বছরের ৩০ জুন তৎকালীন রেলমন্ত্রী লালুপ্রসাদ যাদব কাটোয়াতে এসে শিলান্যাস করেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রেলমন্ত্রী থাকাকালীন ওই রেলপথের অর্ধেক রাস্তা, বর্ধমান থেকে বলগোনা পর্যন্ত কাজের সূচনাও হয়। ২০১২ সালের ২৮ জুলাই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ব্রডগেজ লাইনের ট্রেনের সূচনা করেন। তারপরে কাটোয়ায় প্রস্তাবিত তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের দায়িত্ব নেওয়ার পরে এ বছরের মার্চে পূর্ব রেলের মুখ্য কনস্ট্রাকশনকে ১১২ কোটি ৫৭ লক্ষ টাকা দেয় এনটিপিসি। তারপরেই রেল বাজেটে ওই রেলপথকে ব্রডগেজ করার সিদ্ধান্ত হয়।

স্থানীয় বাসিন্দাদের অনেকেরই ধারনা, প্রস্তাবিত তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের জমি নিয়ে টালবাহানা না থাকলে আগেই বিদায়ের বাঁশি বেজে উঠত কাটোয়া-বলগোনা ন্যারোগেজ লাইনের। তবে এ বিদায় বিষাদের নয় অগ্রগতিরএ কথাও বলছেন তাঁরা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

narrow guage rail katwa saumen dutta
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE