ঘুটঘুটে: রাতের কার্জন গেট। ছবি: উদিত সিংহ।
কার্জন গেট মানে বর্ধমান শহর। আবার উল্টোটাও সত্যি।
গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড থেকে বিজয়চাঁদ রোডে ঢোকার মুখে শতাব্দী প্রাচীন এই তোরণ ইতিহাসের অনেক আলোছায়ার সাক্ষী। কিন্তু ২০০০ সালের পর থেকে ‘বর্ধমান উৎসব’-এর সময় (ডিসেম্বর বা জানুয়ারিতে দিন দশেক) ছাড়া, কার্জন গেটকে আলাদা ভাবে আলো দিয়ে সাজানো হয়েছে, এমন দৃশ্য দেখেনি বর্ধমান সদর। একটু দূরে হালের পুরসভার হাই-মাস্ট বাতিস্তম্ভ রয়েছে। তা থেকে কিছুটা আলো পড়ে কার্জন গেটে। কিন্তু রাত ৯টার পরেই সে আলো নেভানো হয়। অন্ধকারে ডুব মারে বর্ধমানের ‘গর্ব’— কার্জন গেট।
শহরের বিশিষ্টজন থেকে আমজনতার প্রশ্ন, “দেশ বা রাজ্যের বিভিন্ন শহরের ঐতিহ্যবাহী গেটগুলিকে আলোর মালায় সাজিয়ে পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় করে তুলে ধরা হয়। তা হলে বর্ধমানের গর্বের কার্জন গেটকে আলোয় সাজানো হবে না কেন? সে অন্ধকারে থাকবে কেন?” শুধু আলো দিয়ে সাজানো নয়, বর্ধমান শহরের পুরাতত্ত্বচর্চায় আগ্রহী ও ইতিহাস সন্ধিৎসুদের ক্ষোভ, হেরিটেজ-স্থাপত্য হিসেবে কার্জন গেটকে রক্ষা করা হচ্ছে না, উল্টে গেট চত্বরে হকারদের উৎপাত বাড়ছে। গেটের গায়ে গড়ে উঠেছে গুমটি-দোকান। তাদের দৌলতে গেটের স্থাপত্য নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ছে। সে প্রসঙ্গে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন কিউরেটর শৈলেন সামন্ত বলছেন, “প্রাচীন স্থাপত্যকে এ ভাবে নষ্ট করতে দেওয়া উচিত হচ্ছে না।” একমত বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক সৈয়দ তনভীর নাসরিন। তাঁর কথায়, “প্রাচীন স্থাপত্য আমাদের ঐতিহ্য। সেটা বুঝতে হবে।”
ইতিহাস বলছে, বর্ধমানের রাজা বিজয়চাঁদ মহতাব তাঁর সাম্রাজ্য দেখার জন্য লর্ড কার্জনকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। সেই আমন্ত্রণ গ্রহণও করেন লর্ড কার্জন। ১৯০৩-৪ সালে শহরের প্রবেশের মুখে বিজয়চাঁদ ৬৫ ফুট উঁচু একটি গেট তৈরি করান। মূল গেটের দু’দিকে খিলানের ছোট গেটও তৈরি করা হয়। গেটের উপরে রয়েছে তিনটি পাথরের নারীমূর্তি। লন্ডনের সিয়ন হাউসের গেটের ধাঁচে এক বছর বেশি সময় ধরে এই গেটটি তৈরি করেছিল ম্যাকিনট্স বার্ন কোম্পানি। বিজয়চাঁদ এই গেটটির নামকরণ করেছিলেন ‘স্টার অফ ইন্ডিয়া’। ১৯৭৪ সালে পূর্ত দফতর গেটটি সংস্কার করে। তখন নতুন নাম হয় ‘বিজয় তোরণ’। লোকে অবশ্য আজও কার্জন গেট নামেই চেনে।
এই গেট নিয়ে বর্ধমানের অনেকেরই আবেগ যথেষ্ট। বর্ধমান ইতিহাস ও পুরাতত্ত্বচর্চা কেন্দ্রের সম্পাদক সর্বজিৎ যশের কথায়, “কার্জন গেট বর্ধমান শহরের প্রতীক। সেটা অন্ধকারে ডুবে থাকে। অথচ, বাঁকা নদীর পাড়ে সময়স্তম্ভ আলোয় সাজানো। অদ্ভুত বৈপরীত্য!” শহরের বিশিষ্ট আইনজীবী কমল দত্ত বলেন, “কত মানুষ গাড়ি থামিয়ে কার্জন গেটের ছবি তুলতে চান। কিন্তু রাতে গেটটা অন্ধকার থাকায় তাঁরা মুখ গোমড়া করে ফিরে যান। শহরবাসী হিসেবে যা আমাদের কাছে খুবই লজ্জার।” রাষ্ট্রপতি পুরস্কারপ্রাপ্ত শিল্পী সুধীর নাগ মনে করিয়ে দিচ্ছেন, দিল্লির ‘ইন্ডিয়া গেট’, মুম্বইয়ের ‘গেটওয়ে অফ ইন্ডিয়া’র আলোকসজ্জার কথা। তাঁর প্রশ্ন, ‘‘আমাদের গর্বের কার্জন গেটকে স্পটলাইট দিয়ে আর একটু ভাল করে সাজানো যায় না!’’ বিউটিশিয়ান রূপালি আইচের মন্তব্য, ‘‘শহরের মুখ কার্জন গেট। আমরা যেমন মুখকে উজ্জ্বল রাখি, তেমন করেই কার্জন গেটকে সাজানো উচিত।”
কার্জন গেট আলোয় সাজানো ও সৌন্দর্যায়নের চিন্তা-ভাবনা রয়েছে বলে জানিয়েছেন বর্ধমান পুরসভার কর্তারা। পুরপ্রধান স্বরূপ দত্তের আশ্বাস, ‘‘কার্জন গেট আলো দিয়ে সাজানোর ব্যাপারটি গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy