Advertisement
১৯ মে ২০২৪

ঘরে হাতির শুঁড়, মেয়েকে ছুড়লেন বাবা

আমার যা হয় হোক। মেয়েটাকে বাঁচাতেই হবে! বৃষ্টিকে তাই দরজা দিয়ে বাইরে ছুড়ে দিয়েছিলেন সুকল মুর্মু।

মায়ের কোলে বৃষ্টি।

মায়ের কোলে বৃষ্টি।

সৌমেন দত্ত
আউশগ্রাম শেষ আপডেট: ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ০১:১৮
Share: Save:

আমার যা হয় হোক। মেয়েটাকে বাঁচাতেই হবে!

বৃষ্টিকে তাই দরজা দিয়ে বাইরে ছুড়ে দিয়েছিলেন সুকল মুর্মু। নইলে কী যে হত, ভাবতে গিয়ে এখনও হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে সুকল ও তাঁর স্ত্রী সুকুরমণির। ‘‘হাতিটা আর একটু হলে ঘরেই ঢুকে পড়ছিল গো!’’—বৃহস্পতিবার সকালে যখন এক শ্বাসে কথাগুলো বলছিলেন ওই দম্পতি, তখনও তাঁদের চোখেমুখে বুধবার রাতের আতঙ্ক।

আতঙ্ক বলে আতঙ্ক। আউশগ্রামের ভাল্কিতে জঙ্গলঘেঁষা বাগানডাঙায় বাড়ি সুকলের। মাটির দেওয়াল, খড়ের চালা। এক চিলতে কুঁড়েঘরে বাস তিন জনের। বাগানডাঙার ঠিক পিছনে রামহরিপুর ও বাবুইশোল জঙ্গলের ভিতর লুকিয়ে রয়েছে দলছুট এক দাঁতাল। চোলাইয়ের গন্ধ পেয়ে বুধবার গভীর রাতে চাষজমি পেরিয়ে লোকালয়ে চলে আসে হাতিটি। দেড় বছরের শিশুকন্যাকে কোলে নিয়ে সুকুরমণি বলছিলেন, “হাতিটা কলাগাছ খাওয়ার পরেই আমাদের ঘরে ধাক্কা মারে। আমি ভয়ে জানলা গলে বাইরে চলে আসি। ওই জানলা দিয়েই শুঁড়টা গলিয়ে দেয় হাতি।” জখম সুকুলবাবু বলেন, “সমানে শুঁড় নাড়াচ্ছিল। ওইটুকু ঘরে তখন আমি আর মেয়ে। বৃষ্টিকে কোলে নিতেই ওর পায়ে শুঁড়ের ঝাপট লাগল। গতিক সুবিধের নয়। মাথায় কিছু আসছিল না। দরজা দিয়ে মেয়েকে ছুড়ে দিলাম।’’

ততক্ষণে শুঁড়ের ঝাপটে অল্প চোট পেয়েছেন সুকুর। কোনও ক্রমে বাইরে বেরিয়ে মেয়েকে তুলে এক ছুটে রাস্তায় চলে আসেন। দেড় বছরের বৃষ্টির নাক দিয়ে রক্ত বেরোতে থাকে। বাবা-মেয়েকে স্থানীয় জামতাড়া স্বাস্থ্যকেন্দ্রে প্রাথমিক চিকিৎসার পরে আরও কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসক। ডিএফও (বর্ধমান) বিজয়কুমার শালিমাত বলেন, “হাতির হানায় বাগানডাঙা গ্রামের বাবা ও মেয়ে জখম হয়েছে। বৃহস্পতিবার দিনভর কুনকি হাতি ও ঐরাবত গাড়ি এলাকায় ঘুরলেও হাতির সন্ধান পাওয়া যায়নি।” পরপর দু’রাত হাতি লোকালয়ে চলে আসায় ওই এলাকার বাসিন্দাদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়েছে। স্থানীয় ডাঙাপাড়া, মাঝিপাড়া-সহ বেশ কয়েকটি এলাকায় রাত পাহারা দিচ্ছেন যুবকেরা।

হাতির ধাক্কায় ভেঙেছে বাড়ি।

বীরভূমের দিক থেকে ক’দিন আগে অজয় নদ পেরিয়ে পাণ্ডবেশ্বরে ঢুকেই উপদ্রব শুরু করে তিনটি দলছুট দাঁতাল। ইতিমধ্যেই হাতির হানায় পাণ্ডবেশ্বর ও দুর্গাপুরে দু’জনের মৃত্যু হয়েছে। বন দফতরের তাড়া খেয়ে তিনটি হাতি আলাদা হয়ে একটি গত সোমবার চলে আসে আউশগ্রামে। বাকি দু’টিকে দুর্গাপুর থেকে খেদিয়ে বাঁকুড়ায় পাঠাতে পেরেছেন বনকর্মীরা। শেষ হাতিটি আউশগ্রামে ঢোকা ইস্তক অবশ্য বন দফতরকে নাজেহাল করে ছেড়েছে। বর্ধমানের এক বনকর্তা বলেই ফেললেন, “হাতিটা এত বদমায়েশি করছে, আর পারা যাচ্ছে না। টানা চার দিন বিছানায় গা এলাতে পর্যন্ত পারিনি।”

এক বনকর্মীর কথায়, “শম্ভু, কাবেরী আর শিলাবতী গত তিন দিন ধরে গন্ডায় গন্ডায় গিলছে। কিন্তু দলছুট হাতিটাকে ফেরত পাঠানোর বেলায় লবডঙ্কা!” শম্ভু, কাবেরী আর শিলাবতী আসলে কুনকি হাতি। এই তিনটি হাতিই জঙ্গলের ভিতর ঢুকে দলছুট দাঁতালটির খোঁজ করছে। কিন্তু, বুধবার বিকেল ছাড়া ওই হাতির দেখা মেলেনি। এখনও পর্যন্ত সে রকম ক্ষতি না-করলেও বুধবার রাতের ঘটনায় সিঁদুরে মেঘ দেখছে জেলা প্রশাসনও। জঙ্গল থেকে হাতিটি যাতে কোনও ভাবেই লোকালয়ের ভিতর ঢুকতে না পারে তা দেখতে বন দফতরকে বারবার তাগাদা দিচ্ছেন প্রশাসনিক কর্তারা। এক কর্তার কথায়, “গত বছর বিধানসভা ভোটের আগে আউশগ্রাম থেকে লোকালয়ে ঢুকতেই এক দিনে চার জনকে মেরেছিল একটি দাঁতাল। তা নিয়ে বিস্তর জলঘোলা হয়েছিল।’’

শেষ পর্যন্ত গুলি করে মারতে হয় হাতিটিকে। তা নিয়েও কম বিতর্ক হয়নি। ফলে এ বার বাড়তি সজাগ বন দফতর। কিন্তু, এ দাঁতাল লুকোচুরি খেলায় এমন পারদর্শী, যে কাজের কাজ কতটা হবে, তা নিয়ে সংশয়ে বনকর্মীদের একাংশই।

—নিজস্ব চিত্র।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Elephant
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE