Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪
এমসিএ পাশ যুবকের নার্সারি

রুখু জমিই সোনার খনি অচিন্ত্যর

প্রায় ষাট বিঘা জমি কিনেছিলেন বাবা। কিন্তু অনুর্বর সেই জমিতে কী করা যায়, ভেবে পাননি তিনি। ছেলের অবশ্য অন্য পরিকল্পনা ছিল। পুণে থেকে এমসিএ পাশ করার পরে তিনি কোনও কর্পোরেট সংস্থার উচ্চ পদে চাকরি করবেন, ভেবেছিলেন পরিজনেরা।

প্রতাপপুরে কাজের তদারকি। অচিন্ত্য পাইন (ইনসেটে)।

প্রতাপপুরে কাজের তদারকি। অচিন্ত্য পাইন (ইনসেটে)।

অর্পিতা মজুমদার
দুর্গাপুর শেষ আপডেট: ২৬ জুন ২০১৬ ০৬:২০
Share: Save:

প্রায় ষাট বিঘা জমি কিনেছিলেন বাবা। কিন্তু অনুর্বর সেই জমিতে কী করা যায়, ভেবে পাননি তিনি। ছেলের অবশ্য অন্য পরিকল্পনা ছিল। পুণে থেকে এমসিএ পাশ করার পরে তিনি কোনও কর্পোরেট সংস্থার উচ্চ পদে চাকরি করবেন, ভেবেছিলেন পরিজনেরা। সেই পথে না গিয়ে বাড়ি ফিরে এসে ওই জমিতে হরেক রকমের ফুল-ফল-সব্জি ফলাচ্ছেন দুর্গাপুরের অচিন্ত্য পাইন। তৈরি করে ফেলেছেন নার্সারি।

জমির তিন দিকে পুকুর কেটেছেন। বাকি জমির উপরের মাটি তুলে উর্বর মাটি ভরাট করেছেন। ফরিদপুর ব্লকের প্রতাপপুরে সেই জমিতে তৈরি করেছেন নার্সারি। রাসায়নিক সার ছাড়াই হচ্ছে চাষাবাদ। প্রশিক্ষণ নিয়ে, নানা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে লাল কাঁঠাল, কালো আম, পটলের মতো পেয়ারা ফলাচ্ছেন। সে জন্য ইতিমধ্যে পেয়েছেন রাজ্য সরকারের পুরস্কারও।

বাঁকুড়ার রামহরিপুরে রামকৃষ্ণ মিশন স্কুলে পড়ার সময়ে অচিন্ত্য দেখেছিলেন, কী ভাবে মালির যত্নে গাছ ফুল-ফলে ভরে উঠছে। তখন থেকে বাগান করার ব্যাপারে তাঁর উৎসাহ। পুণে থেকে পড়াশোনা সেরে ফেরেন ২০০৪ সালে। তার আগেই তাঁর বাবা, ডিএসপি-র প্রাক্তন কর্মী অধীরেন্দ্রবাবু প্রতাপপুরে ওই জমি কিনেছেন। উঁচু-নিচু, কাঁকুরে সেই জমি সবুজে ভরিয়ে তোলার ভাবনা মাথায় আসে অচিন্ত্যর। বাবার সঙ্গে শলা-পরামর্শ সেরে কাজ শুরু করে দেন।

চাষ করতে গেলে জলের প্রয়োজন সবার আগে। তাই ২২ লক্ষ টাকা খরচ করে সাতটি পুকুর কেটে ফেলা হয়। এর পরে জমির উপরের মাটি তুলে সেখানে ফেলা হয় পুকুর কেটে পাওয়া মাটি। জমি চাষের উপযুক্ত করে নানা প্রজাতির চারা ও বীজ এনে ফুল, ফল, সব্জি ফলানো শুরু হয়। সঙ্গে পুকুরে মাছচাষ, হাঁস-মুরগি প্রতিপালন। অচিন্ত্যবাবু জানান, পুরো কাজে খরচ হয় প্রায় ৪০ লক্ষ টাকা।

প্রতাপপুর গ্রামে ঢোকার মুখে রয়েছে এই ‘দুর্গাপুর বায়ো গার্ডেন’। আশপাশ মিষ্টি গন্ধে ভুরভুর করছে। চেনা-অচেনা অনেক গাছে বিভিন্ন রকমের আম ঝুলছে। ও দিকে ডালিম, পেয়ারা, লিচু, কাঁঠাল, লেবু, আপেল, আঙুর, আমলকি, হরিতকি, কামরাঙা, সবেদা গাছের সারি। ফুলের বাগানে অন্তত ৬০ রকমের জবা, দেড়শোর বেশি প্রজাতির গোলাপ, টগর, পাতাবাহার— কী নেই! অচিন্ত্য জানান, দেশ-বিদেশের বিভিন্ন কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, কৃষি খামার থেকে চারা এনে লাগানো হয়। গাছ বড় হয়ে ফল হলে তা চলে যায় পরীক্ষাগারে। সেখানে ফলের গুণগত মান পরীক্ষা করা হয়। এর পরে ‘মা’ গাছ থেকে চলে চারা-কলম তৈরির কাজ। কলম তৈরি হয়ে গেলে তা দেশের বিভিন্ন জায়গার নার্সারিতে পাঠানো হয়।

রাসায়নিক সার পুরোপুরি মাটিতে মেশে না। ধারাবাহিক ব্যবহারে মাটির উর্বরতাও কমে যায়। সে জন্য বাগানে শুধু জৈব সার ব্যবহার করেন অচিন্ত্য। ২০০৮-এ খড়গপুর আইআইটি থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে এসে বাগানে প্রায় এক বিঘা জমিতে তিনি গড়ে তুলেছেন কেঁচো দিয়ে জৈব সার তৈরির কারখানা। নিজেদের কাজ মেটার পরে বাড়তি সার পাঠানো হয় দুর্গাপুরের বিভিন্ন নার্সারিতে। অচিন্ত্য বলেন, ‘‘সম্পূর্ণ জৈব পদ্ধতির সাহায্য নিয়ে আমরা এগিয়ে চলেছি।’’ কোনও কীটনাশক নয়, পোকামাকড়ের হাত থেকে গাছ বাঁচাতে নিম তেল ব্যবহার করেন তাঁরা।

গত বছর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালনায় ইন্দো-নরওয়ে যৌথ উদ্যোগে ‘অ্যাগ্রো ইকোলজি’র ছ’মাসের সার্টিফিকেট কোর্স করেছেন অচিন্ত্য। তিনি জানান, ‘ন্যাশনাল হর্টিকালচার বোর্ড’ এই নার্সারিকে শংসাপত্র দিয়েছে। মিলেছে রাজ্য সরকারের তরফে জেলার সেরার পুরস্কারও। এখন বাগানে ৫০ রকমের শ’পাঁচেক আম গাছ নিয়ে পরীক্ষা চলছে। তাঁর দাবি, ‘পুষা-অরুণিমা’ আম রাজ্যের অন্য কোথাও চাষ হয় না। নয়া দিল্লির পুষার ‘ইন্ডিয়ান এগ্রিকালচারাল রিসার্চ ইনস্টিটিউট’ থেকে চারা আনা হয়েছে এখানে। ফল হওয়ার পরে গবেষণাগারে পরীক্ষায় সন্তোষজনক ফল মিলেছে বলেও জানান তিনি। আমেরিকার অস্টিন শহরের আম ‘আমেরিকান বিউটি’র বিশেষত্ব গন্ধ ও রঙ। আম ধরছে। তবে গাছ একটু বড় না হলে চারা তৈরি করা যাবে না। ‘ব্ল্যাক ম্যাঙ্গো’র চারা এসেছে তাইল্যান্ড থেকে। অচিন্ত্য জানান, এর চাহিদা সবচেয়ে বেশি। চারা তৈরিতে খরচ গড়ে ১০ টাকা। বিক্রি হয় প্রায় ১২০ টাকা দরে। এ ছাড়া সুবর্ণরেখা, আম্রপালি, গোলাপখাসের মতো আম তো আছেই।

অচিন্ত্য জানান, গোড়ায় বেশ কয়েক লক্ষ টাকা ব্যাঙ্ক ঋণ নিতে হয়েছিল। তা শোধ হয়ে গিয়েছে। তার পরে যা চারা বা ফল-সব্জি বিক্রি করে যা আয় হয়, তা ফের বিনিয়োগ করা হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘‘এখনও পর্যন্ত লগ্নি হয়েছে প্রায় ৫ কোটি টাকা। এই মুহূর্তে লাভের হিসেব করা অর্থহীন। তবে নার্সারির পরিসর বাড়ছে। লাল কাঁঠাল, গোলাপি কাঁঠাল, তাইল্যান্ডের অন্তত আরও ১০ প্রজাতির আম নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে।’’

এমসিএ পাশ করে বাগান করার কথা মাথায় এল কেন? অচিন্ত্য বলেন, ‘‘নিজে চাকরি করে রোজগার করতে পারতাম। কিন্তু শুধু নিজে নয়, আরও কিছু লোকের রোজগারের ব্যবস্থা হয়, এমন কাজ করতে চেয়েছিলাম।’’ বাগানে কাজ করেন জনা তিরিশ কর্মী। উৎপাদিত ফল, শাক-সব্জি, ডিম, মাছ বিক্রি করা হয় লাগোয়া গ্রামে। অধীরেন্দ্রবাবু বলেন, ‘‘বাজারে সব মেলে। তবে হাত ঘুরলেই দাম বাড়ে। এখানে কম দামে জিনিস পান বাসিন্দারা।’’

মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কৃষি উপদেষ্টা প্রদীপ মজুমদার বলেন, ‘‘উদ্যান পালন বিভাগের কর্তাদের কাছে ওই যুবকের উদ্যোগের কথা শুনেছি।’’ জেলা সহ-কৃষি অধিকর্তা (বীজ) মিলন মণ্ডল বলেন, ‘‘রুক্ষ্ম এলাকার মাঝে এমন বড় নার্সারি, না দেখলে বিশ্বাস হয় না। জৈব পদ্ধতির চাষের সাফল্যের নজির এই ফার্ম। উৎসাহীদের কাছে আমরা এর কথা বলে থাকি।’’

ছবি: বিশ্বনাথ মশান।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

plant nursery
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE