রাঁচীর সেই ইউনিয়ন ক্লাব। (ইনসেটে) থরপাখনা নামের সেই পাথরটি। —নিজস্ব চিত্র।
তিন জন বাঙালি এক সঙ্গে হলে পরনিন্দা করে। আর, দশ জন এক সঙ্গে হলে দুর্গাপুজো! কিন্তু একটা গ্রন্থাগার? যখন স্মার্ট ফোনে আঙুল ছোঁয়ালেই চোখের সামনে গোটা বিশ্বের ঠিকানা খুলে যায়—হাতে নিয়ে পাতা উল্টে বই পড়া, তা-ও আবার পাঠ্য বা প্রতিযোগিতামূলক কোনও পরীক্ষার প্রয়োজন ছাড়া—ব্যাপারটাই কার্যত প্রাগৈতিহাসিক!
১৮৬৪ সালে (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তখন সবে তিন বছরের শিশু) রাঁচীর কিছু প্রবাসী বাঙালি মাত্র ছত্রিশ জন সদস্য নিয়ে গড়ে ফেললেন একটা গ্রন্থাগার—হয়তো শুধু এই তাগিদেই যে, কোনও শিক্ষিত মানুষের পেটের খিদেটুকু মেটার পরে বই না হলে যেন দম আটকে যায়! মাসিক চার আনা চাঁদায় তাঁরা বছরে কুড়ি টাকার বই কিনছেন, অনেকগুলো খবরের কাগজ রাখছেন, রাঁচী বেঙ্গলি বয়েজ স্কুলে বসে ঘন ঘন বৈঠক করছেন, মাঝেমাঝেই সদস্য সংখ্যা কমে গিয়ে অর্থাভাব দেখা দিচ্ছে। তৎকালীন প্রশাসনের কাছে সাহায্য চাইছেন। স্থায়ী ভবন তৈরি হচ্ছে।
তখনও তাঁরা জানেন না, এক সুদীর্ঘ সাংস্কৃতিক যাত্রাপথের ভিত্তি-প্রস্তর গাঁথছে সেই ‘রাঁচী পাবলিক লাইব্রেরি’! তখনকার সেই তিন বছরের শিশুটি অনেক বছর পরে বিশ্ববিখ্যাত কবি হয়ে এই গ্রন্থাগার সম্পর্কে শুনে নিজে চিঠি লিখে পাঠাবেন তাঁর রচনা সংকলন! ১৯৩১ সালে রবিঠাকুরের লেখা সেই চিঠি-সহ বইটি এখনও কেউ ভালোবেসে দেখতে চাইলে লকার থেকে বেরিয়ে আসবে।
১৮৭২ সালের সার্ভে বিভাগের তৈরি ছোটনাগপুরের ম্যাপেও এই গ্রন্থাগার জায়গা করে নিয়েছিল। তার অবস্থান চিহ্নিত করতে ম্যাপে উল্লেখ ছিল ‘থরপাখনা’ নামে এক পাথর! ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত পাবলিক লাইব্রেরি নামের সঙ্গে থরপাখনা ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে ছিল। ওই পাথরের নামে জায়গাটাও ‘থর মহল্লা’। কী এমন পাথর! স্থানীয় মুণ্ডা প্রধান চরণ পাহান ছিলেন সেই পাথর-সহ বিশাল মাঠঘাটের মালিক। প্রকৃতির খেয়ালে বিশালাকৃতি সেই পাথর উল্লম্ব ভাবে দাঁড়িয়ে ছিল প্রাচীনকাল থেকে। মুণ্ডাগোষ্ঠী ফি বছর সেখানে পুজো দিত, বিশ্বাস করত পাথরটা বাড়ছে, এক দিন পাখির মত ডানা মেলে উড়ে যাবে। ‘উড়ে গিয়েছেও’ হয়তো, না হলে অনেক খুঁজেও দেখা হল না কেন!
চরণ পাহানের মাঠ-ঘাট-পাথর বিত্তশালী বাঙালিরা কিনে ফেলেন ধীরে ধীরে। ১৯৪৭ সালের সুকুমার হালদারের লেখায় রয়েছে, ‘বর্তমানে ‘থরপাখনা’ পাথরটি শিশিরকুমার বসু’র (ঋষি অরবিন্দের ভগ্নীপতি) ব্যক্তিগত বাংলোর হাতার মধ্যে আছে’। তার পরে মালিকানা বদল হয়েছে। গত বছর কুড়ি পাথরটাকে কেউ দেখেননি। জানা গেল, সম্ভবত বর্তমান মহিলা পলিটেকনিক কলেজের বাউন্ডারি দেয়ালের মধ্যে হারিয়ে গিয়েছে ‘থরপাখনা’। কিন্তু যত দিন তার নাম আর ইতিহাস রইল, সে-ও রইল বইকি।
এর পরে আর এক অধ্যায়। ১৮৮৬ সালে অটলবিহারী মৈত্র রাঁচীর ডেপুটি কমিশনার হয়ে আসেন। তাঁর উদ্যোগে বেশ কিছু মান্যগণ্য মানুষকে নিয়ে তৈরী হয় ‘ছোটনাগপুর ক্লাব’। ইংরেজি ঘরানার ক্লাব। সুতরাং শুরুতেই কুমার জগৎমোহনের অনুদানের ছ’শো টাকায় কিনে ফেলা হল রেইনি সাহেবের পুরনো বিলিয়ার্ড টেবিল। যদিও স্থায়ী ভবন না থাকায় সে টেবিল রাখা নিয়ে বিস্তর সমস্যা চলে অনেক বছর। অনেক বার ঠাঁইনাড়া হয়ে ১৯৩৯ সালের ৭ মার্চ পুরুলিয়া রোডে বর্তমান বাড়িটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হল। ‘ছোটনাগপুর ক্লাব’ তত দিনে নাম বদলে হয়ে গিয়েছে ‘ইউনিয়ন ক্লাব’। এর আগে ১৯৩৮ সালের ২৭ নভেম্বর ঘটে গিয়েছে সেই মহা সমন্বয়—‘রাঁচী পাবলিক লাইব্রেরি’, নাটক পাগল ‘টাউন ক্লাব’ ও ‘ইউনিয়ন ক্লাব’— মিলে হল ‘ইউনিয়ন ক্লাব ও লাইব্রেরি’।
এই ক্লাব ও লাইব্রেরি গড়ে তোলার সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য ভাবে যুক্ত কিছু নাম পাওয়া গেল ১৯৪৮ সালের সুবর্ণজয়ন্তীর স্মরণিকা পুস্তকে। প্রফুল্লকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, উদ্ধবচন্দ্র রায়, রাইচরণ ঘোষ, কালীপদ ঘোষ, চারুচন্দ্র মিত্র, আরও অনেক নাম! সংস্কৃতিমনস্ক এই সব মানুষের পরম্পরা দেড়শো বছরেরও বেশি সময় ধরে ধারাবাহিক ভাবে সাহিত্য-নাটক-গান-সিনেমা ইত্যাদির মাধ্যমে প্রতিবেশী রাজ্যে এক টুকরো ‘বাংলা’ কে বুকে করে আগলে রেখেছেন।
হালফিলে আমরা যা দেখতে অভ্যস্ত—শহুরে বাবা-মায়েরা ছেলেমেয়েদের স্কুলে ভর্তির সময়ই ‘বাংলা’ কে তৃতীয় ভাষায় ঠেলে দেন, চারদিকে অনেক বাংলা গ্রন্থাগারের ‘একে একে নিভিছে দেউটি’, তখন দেখে অবাক লাগে, পঁয়তাল্লিশ হাজার বইয়ের সম্ভারে সমৃদ্ধ ‘ইউনিয়ন ক্লাব অ্যান্ড লাইব্রেরি’। শীতের রাত সাড়ে আটটাতেও নিষ্ঠা ভরে বসে বৃদ্ধ গ্রন্থগারিক ঘোষবাবু ও চক্রবর্তীবাবু। কেউ যেন বই নিতে এসে ফিরে না যান!
বিস্ময় দেখে রাঁচির ইতিহাস বিশেষজ্ঞ রবিরঞ্জন সেন বললেন, ‘‘প্রবাসী বাঙালিরা একটা অস্তিত্বের সংকটে ভুগি বলে প্রাণপণে চেষ্টা করি ‘বাংলা’ যেন ভুলে না যাই। পরের প্রজন্মকে যেন কিছুটা বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত করাতে পারি।’’ কালের স্রোতে বিলীন হয়ে যাওয়ার ভবিতব্য থেকে বাঁচতে হলে সময়োপযোগী ভাঙাগড়ার খেলায় সদা সামিল হতে হয়। এই সত্যটি বুঝে ‘ইউনিয়ন ক্লাব অ্যান্ড লাইব্রেরি’ (ইউসিএল) তৈরি করেছে ক্লাব লাগোয়া একটি সিনেমা হল, যার ভাড়ায় কিছুটা আর্থিক সাশ্রয় হয়।
বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতির নিয়মিত চর্চা-অনুষ্ঠান ছাড়াও এখানে নানা রকম ক্রীড়া ও প্রশিক্ষণ চলে সারা বছর। সম্প্রতি ক্লাবের সম্পাদক শ্বেতাঙ্ক সেনের কোচিংয়ে ‘ঝাড়খণ্ড মহিলা ভলিবল’ দল জাতীয় স্তরের প্রতিযোগিতা জিতে এসেছে। প্রতি রবিবার চলে বাংলা শেখানোর ক্লাস —ছাত্র-ছাত্রীদের বয়স পাঁচ থেকে পঁয়ষট্টি। অনেকেই অবাঙালি। জার্মান, ফ্রেঞ্চ এর মতো বিদেশি ভাষা শেখার ব্যবস্থাও আছে। এত সব বহুমুখী কার্যকলাপের ফলে এক দিকে কিছু আয় হয়, সঙ্গে হয় জন-সংযোগ। একশো তিপ্পান্ন বছর আগে প্রবাসী বাঙালিরা রাঁচীতে বাংলা সাহিত্য সংস্কৃতি-চর্চার যে ধ্বজা উড়িয়েছিলেন, তা সগৌরবে উড়ছে আজও! এ ভাবেও টিকে থাকা যায়—আমরা শিখব কি!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy