নিহত প্রণব সরেন।
ঘড়িতে তখন রাত বারোটা দশ।
বড়বাবু নির্দেশ দিলেন, ‘মোটর বাইকে গোটা ঘাটাল শহরে টহল দেওয়া হবে। চটপট রেডি হয়ে নাও।’ হাতে একটা লাঠি নিয়ে এক সহকর্মীর বাইকে চেপে থানা থেকে বেরিয়ে পড়লাম। সঙ্গে ছিলেন বড়বাবু নিজেও। প্রতিদিনই থানা থেকে আমরা কেউ না কেউ সাদা পোশাকে শহর ছাড়াও গোটা থানা এলাকায় টহল দিই। কিন্তু পুজোর আগে বাড়তি সতর্কতা হিসেবে বড়বাবু এখন শহরের উপর বেশি জোর দিয়েছেন। সেই মতো এ দিনও আমরা টহলে বেরিয়ে পড়ি। বাইকে করে থানা থেকে বড়জোর ২৫০ মিটার দূরত্ব এসেছি। শহরের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের আলামগঞ্জ এলাকায় (ঘাটাল পুরসভা পেরিয়ে শহরের বানেশ্বর মন্দিরের ঠিক কাছে) হঠাৎ দেখি, সাত-আট জনের একটি দল রাস্তা দিয়ে এগিয়ে আসছে। তাদের হাতে কিছু একটা রয়েছে বুঝতে পারছি, কিন্তু দূর থেকে ঠিক দেখা যাচ্ছে না। আমরা তিনটি বাইক নিয়ে টহলে বেরিয়েছি। আমি ঠিক মধ্যিখানের বাইকে রয়েছি। কাছে আসতে দেখি, ওই যুবকদের পরনে ছিল গেঞ্জি ও লুঙ্গি। কারও মুখ ছিল কাপড়ে ঢাকা, কারও মাথায় পাগড়ির মতো জড়ানো কাপড়। কাঁধে ছিল ব্যাগ এবং হাতে ৭-৮ ফুট লম্বা বাঁশ।
এত রাতে রাস্তায় এ ভাবে দাঁড়িয়ে দেখতে দেখে বড়বাবু তাদের মতলব জানতে চাইলেন। বড়বাবু ওঁদের বলেন, আমরা পুলিশের লোক। আমাদের মারছিস কেন? কথা বলা মাত্রই ওঁরা আমাদের বাঁশ দিয়ে মারতে শুরু করল। দুষ্কৃতীরা বড়বাবু-সহ আমাদের সবাইকেই মারতে শুরু করে। প্রায় পনেরো মিনিট ধরে ওঁরা আমাদের মারতে থাকে। শহরের ঘিঞ্জি এলাকায় এমন ঘটনায় আমরা সকলেই হতভম্ব। সেই সময় আমিও বাইকে থেকে নেমে লাঠি দিয়ে ওঁদের পাল্টা মারার চেষ্টা করি। কিন্তু ওঁরা তিনটি দলে ভাগ হয়ে গিয়েছিল। তারপরেই দেখি, দু’জন দুষ্কৃতী ঘটনাস্থলের কাছেই একটি বাড়ির পিছন দিয়ে ছুটে পালাচ্ছে। আমি গিয়ে তাঁদের পাকড়াও করি।
ঘটনার পর ঘাটালের আলমগঞ্জে চলছে পুলিশি টহল।
তখনই একটা গুলি চলার শব্দ পাই। কী করব ভাবার আগেই ওই দুই দুষ্কৃতী হাত ছেড়ে পালায়। দৌড়ে গিয়ে দেখি, আমাদের এক সহকর্মী প্রণব সরেন মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে। তাঁর বুকের ডান দিকে গুলি লেগেছে। রক্তে তাঁর গা ভেসে যাচ্ছে। বড়বাবুরও হাতে আঘাত লাগে। সেই সময় দুষ্কৃতীরা ফের গুলি চালায়। যদিও সেই গুলি কারও গায়ে লাগেনি। বড়বাবুও পাল্টা গুলি চালান। কিন্তু তখন দুষ্কৃতীরা চম্পট দিয়েছে। প্রণবকে তখন আমরা পাশের একটি চালের দোকানে নিয়ে যাই। দোকানের শার্টার নামিয়ে দিই। প্রণব তখন বলছিল, আমার সব শেষ হয়ে গেল...। বড়বাবু ও অন্য সহকর্মীরা থানায় খবর দিয়ে দেন। কিছুক্ষণ পরেই থানা থেকে পুলিশ বাহিনী ঘটনাস্থলে হাজির হয়। প্রণবকে নিয়ে আমরা হাসপাতালে যাই। বড়বাবু আমাদের হাসপাতালে পাঠিয়ে অন্য পুলিশ কর্মীদের নিয়ে শহরের পাহাড়িবাগান হয়ে চাউলি-সিংহপুরের দিকে দুষ্কৃতীদের ধরতে তল্লাশিতে বেরোয়। কেননা, দুষ্কৃতীরা ওই পথ ধরেই পালিয়েছে বলে অনুমান করা হয়।
রাত একটায় হাসপাতালের পথে প্রণবের মৃত্যু হয়। আমার এক সহকর্মীর অবস্থা খারাপ হওয়ায় তাঁকে কলকাতায় পাঠানো হয়। অন্য এক সহকর্মীরও বুকে ও ঘাড়ে আঘাত লাগায় ঘাটাল হাসপাতালেই তাঁর চিকিৎসা শুরু হয়। হাসপাতাল থেকে আমি ফের থানায় ফিরে আসি। তখনও একটা কথাই মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে, এক সহকর্মীর প্রাণ গেল। কিন্তু দুষ্কৃতীরা অধরাই।
প্রণবের দেহ তখন হাসপাতালের মর্গে চিরনিদ্রায় শায়িত।
ছবি: সৌমেশ্বর মণ্ডল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy