রাস্তার কলের মুখে পাইপ লাগিয়ে জল নিয়ে যাওয়া হচ্ছে বাড়িতে। খড়্গপুরের ভবানীপুরে (বাঁ দিকে)। পাম্প লাগিয়ে পাইপের মাধ্যমে নিমপুরার একটি বাড়ির কল থেকে জল নেওয়া হচ্ছে। ফলে আশপাশের বাড়ির লোকেরা জল পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ (ডান দিকে)। — রামপ্রসাদ সাউ।
প্যাঁচেই বাড়ছে দুর্ভোগ।
টাইমকলের সংযোগের সঙ্গে মাটির নীচে পাইপের প্যাঁচে সরাসরি যুক্ত হচ্ছে পাম্প। বাড়ছে জল চুরি।
ঠিক কী ভাবে হচ্ছে এই কাজ?
বাড়িতে পুরসভার টাইমকলের সংযোগ রয়েছে। সেই জলে ভরার কথা মাটির নীচের রিজার্ভার। তারপর পাম্প দিয়ে জল তুলে ভরা হয় তিনতলার ছাদে বসানো ট্যাঙ্ক। কিন্তু গরমে টাইমকলে জল পড়ে সুতোর মতো। ফলে, রিজার্ভার ভরে না। তাই জলের সংযোগে কারসাজি করে সরাসরি জুড়ে দেওয়া হচ্ছে পাম্পের সঙ্গে। পাম্প চালাতেই নিমেষে ভর্তি হচ্ছে ছাদে বসানো জলট্যাঙ্ক।
খড়্গপুর শহরে এ ভাবেই চলছে জল চুরি। বাড়ির কল অথবা রাস্তার কল থেকে পাইপ টেনে পাম্পের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত করা হচ্ছে। এর জেরে বাড়িতে সংযোগ নিয়েও বিপাকে পড়ছেন একাংশ শহরবাসী। কারণ, একটি বাড়ি কারচুপি করে জল টেনে নেওয়ায় অন্য বাড়ির কলে জল পড়ছে না। কোথাও জল পড়লেও বেগ নেই। এই পরিস্থিতিতে এলাকার যে সব বাসিন্দার পাম্প কেনার ক্ষমতা নেই তাঁরা তীব্র জলসঙ্কটের মুখে পড়েছেন। অথচ জলচুরির কথা জেনেও পুরসভা হাত গুটিয়ে বসে বলেই অভিযোগ।
পুরসভা সূত্রে খবর, এখন খড়্গপুর শহরে ১২,৮০০টি বৈধ সংযোগ রয়েছে। এ ছাড়াও প্রতিটি ওয়ার্ডে গড়ে প্রায় ২০টি পর্যন্ত অবৈধ পানীয় জলের সংযোগ রয়েছে। স্থানীয়দের অভিযোগ, বহু বাড়িতে পুরসভায় আবেদন না করেই ওই সংযোগ নেওয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে বিভিন্ন সময়ে ভোটের মুখে কাউন্সিলরা ওই সংযোগ দিয়েছেন বলে দাবি স্থানীয়দের। কিন্তু সব জেনেও পড়শির সঙ্গে সংঘাত এড়াতে মুখ বুজে সহ্য করতে হচ্ছে। ভবানীপুরের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের এক বাসিন্দার কথায়, ‘‘আমার পাশের বাড়ির সংযোগ বৈধ নয় বলেই জানি। এক সময় কাউন্সিলর দাঁড়িয়ে থেকে ওই সংযোগ দিয়েছিলেন। পুরসভার এ সব খতিয়ে দেখা উচিত।’’ পুরসভা সূত্রে খবর, এমন অভিযোগ এলেও লাইন কাটতে গেলে মানবিকতা ও অশান্তির ভয়ে হাত গুটিয়ে থাকতে হচ্ছে।
পুরসভার বিস্তীর্ণ এলাকায় স্থানীয় পাইপ মিস্ত্রিদের কারসাজিতে জলচুরি বাড়ছে বলে অভিযোগ। শহরের খরিদা এলাকার এক পাইপলাইনের মিস্ত্রি বললেন, ‘‘আমি নিজে ভবানীপুর, সুভাষপল্লি, খরিদা এলাকায় বহু বাড়িতে সরাসরি টাইমকলের লাইনে পাম্প জুড়ে দিয়েছি। দেখে বুঝতেও পারবেন না চ্যালেঞ্জ।’’ এখন শহরের ২, ৩, ৪, ৫, ৬, ৭, ৮, ১২, ১৯, ২৩, ২৪, ৩১, ৩২, ৩৩, ৩৪, ৩৫ নম্বর ওয়ার্ড এলাকায় এই সমস্যা সবচেয়ে বেশি। শহরের ১২ নম্বর ওয়ার্ডের নিমপুরা দুর্গামন্দির এলাকার বাসিন্দা স্কুলশিক্ষক দিলীপ চক্রবর্তী বলেন, “এলাকায় জলের সমস্যা দীর্ঘদিনের। তাই কিছু মানুষ জল পেতে টাইমকলের পাইপে সরাসরি পাম্প জুড়ে দিচ্ছে। বহুবার পুর-কর্তৃপক্ষের নজরে এনেছি। তবে সমস্যা মেটেনি।’’
বহু এলাকায় এমন সমস্যার সমাধানে জল সরবরাহের সময়ে বিদ্যুতের ট্রান্সফর্মার বন্ধ করে রাখা হচ্ছে। কিন্তু অধিকাংশ ওয়ার্ডে নদীর জলের বিকল্প হিসেবে ছোট ছোট গভীর নলকূপ গড়ে জল দেওয়ায় বিদ্যুৎ না থাকলে পাম্প চলছে না। ৩২ নম্বর ওয়ার্ড কমিটির সদস্য মিহিররঞ্জন শীল বলেন, ‘‘জল চুরি হচ্ছে। গভীর নলকূপ থাকায় আমরা বিদ্যুৎ বন্ধ করতে পারছি না। আবার বাড়িতে গিয়ে হানা দিতেও পারছি না। সব জেনেও পুরসভা নীরব থাকলে এই চুরি আটকানো যাবে না।’’ তবে বিদ্যুৎ বন্ধ করলে যে পার্থক্য বোঝা যায় তা বলছেন শহরবাসী। ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের তালবাগিচার বাসিন্দা গৌরাঙ্গ শতপথির কথায়, ‘‘বাড়ি বাড়ি পাম্প দিয়ে সরাসরি টাইমকলের জল টানা হচ্ছে। কেউ জল পাচ্ছে না আবার কেউ টাইমকলের জলে বাড়ির ইমারতি কাজ করছে। কখনও জল আসার সময়ে লোডশেডিং থাকলে জল পাচ্ছি। আবার বিদ্যুৎ এলেই জল বন্ধ হচ্ছে। পুরসভার ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।’’ স্থানীয় সিপিএম কাউন্সিলর স্মৃতিকণা দেবনাথ বলেন, ‘‘জল সমস্যা নিয়ে দু’দিন আগেই পুরসভার স্মারকলিপি দিয়েছি। পাম্প দিয়ে মানুষ জল টানছে। মাইকে প্রচার করেও নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনি। পুরসভা সব জেনেও অভিযান করছে না।’’
এক দিকে জলসঙ্কট অন্য দিকে জলচুরির সাঁড়াশি আক্রমণের মুখে পড়েছেন পুরসভা কর্তৃপক্ষ। চাপে পড়ে জলচুরি রুখতে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলছেন পুরপ্রধান প্রদীপ সরকার। তাঁর বক্তব্য, “এ বার এখন পর্যন্ত জলসঙ্কট শহরে দেখা যায়নি। তবে জলচুরি চলছে। আগামী ১৯ মে পরেই আমরা শহরজুড়ে এ ভাবে জলচুরি রোধে অভিযানে নামব। তার আগে আমরা মাইকে প্রচার ও লিফলেট ছড়াব। এ ক্ষেত্রে যাঁদের ধরা হবে তাঁদের যাতে আর কোনও দিন জলের সংযোগ দেওয়া না হয় সেই ব্যবস্থা করব।’’ এই বিষয়ে স্থানীয় মানুষকে সচেতন হতে হবে বলে দাবি পুরপ্রধানের।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy