Advertisement
০৭ মে ২০২৪

মকর-পরবে জঙ্গলমহল

জঙ্গলমহলে পৌষ সংক্রান্তির আগের রাতটা টুসু পুজোর রাত। শনিবার তাই ঝাড়গ্রামের আদিবাসী বাজার ও জুবিলি বাজারে ছিল শেষ মুহূর্তের কেনাকাটার ব্যস্ততা। আদিবাসী বাজারে টুসুর পসরা নিয়ে বসেছিলেন বিনপুরের কেন্দডাংরি গ্রামের দুর্লভ দাস, মধুসূদন দাসের মতো টুসু বিক্রেতা।

বিকিকিনি: ঝাড়গ্রাম বাজারের টুসুমূর্তি বেচাকেনা চলছে। নিজস্ব চিত্র

বিকিকিনি: ঝাড়গ্রাম বাজারের টুসুমূর্তি বেচাকেনা চলছে। নিজস্ব চিত্র

নিজস্ব সংবাদদাতা
ঝাড়গ্রাম শেষ আপডেট: ১৪ জানুয়ারি ২০১৮ ০১:২৩
Share: Save:

মূলত কুড়মি ও আদিবাসী সম্প্রদায়ের প্রধান উত্সব এটি। তাকে ঘিরে ঝাড়গ্রাম এবং পশ্চিম মেদিনীপুরের জঙ্গলমহলে খুশির জোয়ার।

যদিও আনন্দের মধ্যেও বেশ কিছু কাঁটা রয়ে গিয়েছে। এখনও বেশির ভাগ জায়গায় সরকারি সহায়ক মূল্যে চাষিদের কাছ থেকে ধান কেনা হয়নি। ফলে ফড়েদের পোয়াবারো। তাই উত্সবের আয়োজন করতে এবং নতুন জামাকাপড় কিনতে ফড়ে ও মহাজনদের কাছে কম দামে ধান বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন বহু প্রান্তিক চাষি। তাই অনেক বাড়িতে এ বার উত্সবের আয়োজন সাদামাঠা। তবে আড়ম্বরের অভাবেও জমে উঠেছে উৎসবের মেজাজ। সঙ্গে যোগ্য সঙ্গত কড়া ঠান্ডা আর মিঠে রোদ! চলছে মোরগের লড়াই, পার্বণি মেলাও।

জঙ্গলমহলে পৌষ সংক্রান্তির আগের রাতটা টুসু পুজোর রাত। শনিবার তাই ঝাড়গ্রামের আদিবাসী বাজার ও জুবিলি বাজারে ছিল শেষ মুহূর্তের কেনাকাটার ব্যস্ততা। আদিবাসী বাজারে টুসুর পসরা নিয়ে বসেছিলেন বিনপুরের কেন্দডাংরি গ্রামের দুর্লভ দাস, মধুসূদন দাসের মতো টুসু বিক্রেতা। তুষ, খড় আর মাটি দিয়ে তৈরি হয় টুসুর মূর্তি। বাজারে বসেই রঙিন কাগজের কল্কা ফুলের সাজে প্রতিমা সাজাচ্ছিল বাড়ির বড়দের সঙ্গে আসা নবম শ্রেণির সোমা দাসও। দুর্লভবাবু জানান, ৩০০টি টুসু মূর্তি বানিয়েছিলেন তিনি। ২০ ও ৩০ টাকা দামের মূর্তিগুলি দ্রুত বিক্রি হয়ে গিয়েছে। তুলনায় কম বিকিয়েছে ৮০ ও ১০০ টাকা দামের কয়েকটি মূর্তি।

উৎসবের মরসুমে কেন এমন মন্দা? হাটে আসা বনমালী মাহাতো, গুরুপদ দলুইদের বক্তব্য, সরকারি দরে ধান বিক্রি করা যায়নি। তার আগেই মহাজনের কাছে অভাবী বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন তাঁরা। উত্সবের খরচ তাই মেপে করতে হচ্ছে। এ দিকে, মকর পরবে পিঠেপুলির জন্য নারকোলের দামও আকাশছোঁয়া। বিনপুরের ভেটলি গ্রামের লক্ষ্মী আহিরের কথায়, “পিঠের জন্য নারকোল তো লাগবেই। ১০০ টাকা দিয়ে একজোড়া বড় নারকেল কিনেছি।”

শনিবার রাতভর আদিবাসী-মূলবাসীদের বাড়িতে টুসু পুজোর আয়োজন করা হয়েছিল। ফল, পিঠে, খই, মুড়কির নৈবেদ্য সাজিয়ে এক রাতে ষোলোবার টুসুমণির পুজো করেন কুমারী ও বিবাহিত মহিলারা। সারারাত গান শুনিয়ে ‘জাগিয়ে রাখা’ হয়েছিল সমৃদ্ধির দেবী টুসুমণিকে। আজ, রবিবার হবে টুসুর ভাসান। এ দিন সকাল থেকেই জঙ্গলমহলের বিভিন্ন নদী ও জলাশয়ে টুসু মূর্তি বিসর্জন দেওয়া শুরু হবে। ভাসানের পরে সেখানেই স্নান সেরে নতুন জামাকাপড় পরার রেওয়াজ রয়েছে। প্রথা মতো বাড়ি-বাড়ি তৈরি হয়েছে রকমারি পিঠে। সাবেক প্রথা মেনে মূলবাসীদের বাড়িতে তৈরি হয়েছে মাংসের পুর দেওয়া সুস্বাদু ‘মাঁস পিঠা’।

লোকশিল্প ও সংস্কৃতি গবেষক সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের জানান, মকর-পরব জঙ্গলমহলের ‘পৌষালি নবান্ন’। নতুন ধান ঘরে তোলার আনন্দে লক্ষ্মীস্বরূপা সমৃদ্ধির দেবী টুসুমণিকে পুজো করা হয়। কুড়মি সম্প্রদায়ের পাশাপাশি সাঁওতাল, লোধা-শবর, মুন্ডা-সহ আদিবাসী-মূলবাসীদের কাছে মকর-পরব সবচেয়ে বড় উত্সব বলে বিবেচিত। সুব্রতবাবুর কথায়, “এখন তো মকর পরব জঙ্গলমহলের সর্বজনীন উত্সবে পরিণত হয়েছে।” শনিবার ঝাড়গ্রামের আদিবাসী বাজারে টুসু মূর্তি কিনতে এসেছিলেন কলকাতায় ডাক্তারির ছাত্রী দেবদত্তা গঙ্গোপাধ্যায়। তাঁর কথায়, “আমার জন্মস্থান ঝাড়গ্রাম। পৌষ সংক্রান্তির আগের রাতে বাড়িতে টুসুর মূর্তি সাজিয়ে আলপনা দিই। পিঠে বানাই।”

এ ভাবেই পরবে মেতেছে জঙ্গলমহল।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Tusu Puja Celebration
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE