বীরেন্দ্রনাথ শাসমল স্মারক বক্তৃতা। বক্তা সমীরকুমার দাস। নিজস্ব চিত্র
কখনও কোনও ধরাবাঁধা ছকে আটকে থাকেননি তিনি। চেয়েছিলেন গণতন্ত্রের প্রসার, পরিধির বিস্তার। বীরেন্দ্রনাথ শাসমল সম্পর্কে এমনই মত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক সমীরকুমার দাসের। বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ে স্মারক বক্তৃতায় এসে বীরেন্দ্রনাথ সম্পর্কে সমীরবাবুর বক্তব্য, “কংগ্রেসও তাঁকে হজম করতে পারেনি, কলকাতাও তাঁকে হজম করতে পারেনি। অথচ তিনি কোনও অংশে কম নন। তিনি সব কিছুই হতে পারতেন। কিন্তু কিছুতেই তাঁকে কোনও একটা ধরাবাঁধা জায়গায় বেঁধে রাখা যায়নি। আসলে গণতন্ত্রটাই এ রকম। তার নিজস্ব চেহারাটাই হচ্ছে সব সময় তার নিজের সীমানাটা অতিক্রম করে। বীরেন্দ্রনাথ শাসমল সেই অর্থেই গণতান্ত্রিক যে কোনও ধরাবাঁধা ছকের মধ্যে তাঁকে ধরে রাখা যায়নি। না কংগ্রেস, না কলকাতা, না অন্য কিছু।”
বৃহস্পতিবার বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এপিজে আব্দুল কালাম সভাকক্ষে ‘বীরেন্দ্রনাথ শাসমল স্মারক বক্তৃতা’- র আয়োজন করা হয়। এ বার ছিল এই বক্তৃতার দ্বিতীয় বর্ষ। ‘বীরেন্দ্রনাথ শাসমল ও ভারতে গণতান্ত্রিক চর্চার নির্মাণ’ বিষয়ে বক্তব্য রাখেন সমীরবাবু। ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য রঞ্জন চক্রবর্তীও।
বীরেন্দ্রনাথের জন্ম কাঁথির চণ্ডীভেটিতে। উচ্চতর আইন শিক্ষার জন্য তিনি ইংল্যান্ডে গিয়েছিলেন। ব্যারিস্টারি পাশ করে কলকাতা হাইকোর্টে যোগ দেন। আইনজ্ঞ হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন। সেই সঙ্গে বরাবর সশস্ত্র বিপ্লববাদীদের প্রতি সমর্থন ছিল তাঁর। চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন পর্বে বিপ্লবীদের হয়ে বিনা পারিশ্রমিকে একাধিক মামলা লড়েছেন তিনি। পঞ্চম জর্জের ভারত আগমনের বিরুদ্ধে ধর্মঘটে যোগ দিয়ে তাঁর কারাবাস পর্যন্ত হয়েছিল। আর প্রেসিডেন্সি জেলে থাকাকালীনই বীরেন্দ্রনাথ লেখেন আত্মজীবনী— ‘স্রোতের তৃণ’। বিদেশী দ্রব্য বর্জন আন্দোলনেও যোগ দিয়েছিলেন তিনি। বীরেন্দ্রনাথ রাজনীতিকে সমাজকল্যাণের সমার্থক মনে করতেন। মেদিনীপুর ইউনিয়ন বোর্ডের কর-বন্ধ আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। লবণ সত্যাগ্রহে যোগ দিয়েছিলেন। এক সময় প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতিও নির্বাচিত হন।
দেশপ্রেমের উদ্দীপনা, সামাজিক দায়বদ্ধতা ও অঙ্গীকারের চেতনায় সমর্পিত সেই দেশপ্রাণ বীরেন্দ্রনাথের জীবনের নানা দিক এ দিন ফুটে ওঠে সমীরবাবুর বক্তব্যে। ছিল প্রশ্নোত্তর পর্বও। উপাচার্য রঞ্জনবাবু আবার মনে করিয়ে দেন, “বীরেন্দ্রনাথ শাসমল কখনও মেদিনীপুরের পরিচয়কে ছুঁড়ে ফেলেননি।’’ সমীরবাবু বলছিলেন, “বীরেন্দ্রনাথ শাসমল সত্যিই কোনও বৈষ্যমের শিকার হয়েছেন কি হননি, সেটা আমার কাছে বড় নয়। হয়তো তিনি মনের কথা খুব পরিষ্কার করে লিখতে পারেননি, বা লিখেছেন তা আজও আবিষ্কৃত হয়নি, হয়তো ভবিষ্যতে হবে।’’ রাষ্ট্রবিজ্ঞানের এই শিক্ষকের কথায়, ‘‘একটা লোক কলকাতায় এলেন, এতবড় একজন ব্যারিস্টার, বিরাট মাপের মানুষ, কিন্তু সে কখনওই কলকাতার হয়ে উঠতে পারলেন না। কলকাতায় থেকেও কলকাতার সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হলেন না। এটা গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। হলেন না বলেই হয়তো তাঁর কাছে গণতান্ত্রিক সম্ভাবনাটা জাগ্রত ছিল।’’
বীরেন্দ্রনাথের আত্মজীবনীর প্রসঙ্গ টেনে সমীরবাবুকে বলতে শোনা যায়, “উনি মনে করতেন যে তৃণটা ভেসে ভেসে যায়, তার নিজের কোনও ইচ্ছে নেই। একটা জিনিস আমার মনে হয়েছে, তৃণটা কিন্তু ভেসে থেকেছে। কখনওই ডুবে যায়নি। সেই তৃণটা আজ আমাদের কাছে এসে পৌঁছেছে, আমরা যাঁরা প্রায় ডুবতে বসেছি। সেই তৃণটা ধরেই বোধহয় আমাদের গণতান্ত্রিক বোধটাকে জাগ্রত করতে হবে।’’
সমীরবাবুর এই কথা শুনে করতালির ঝ়ড় উঠেছে, সভাকক্ষে হাজির সকলেই সহমত হয়েছেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy