Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

খেজুর গাছই সাবাড়, নলেনের মৌতাত জোগাবে কে

কয়েক বছর আগেও নদিয়ার চর শম্ভুনগর বা নতুন শম্ভুনগরে কার্যত খেজুরের বন ছিল। গ্রামে পাকা রাস্তা করতে গিয়ে সে সব নিশ্চিহ্ন। ছবিটা মাজদিয়া, চাপড়া, কৃষ্ণগঞ্জ সর্বত্র এক।

—নিজস্ব চিত্র

—নিজস্ব চিত্র

দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায় ও সামসুদ্দিন বিশ্বাস
শেষ আপডেট: ০৭ জানুয়ারি ২০১৮ ০৩:২৩
Share: Save:

সুন্দরী নতুন বৌ ঘরে আনবে বলে বিবি মাজু খাতুনকে তালাক দিয়েছিল ‘শিউলি’ মোতালেফ মিয়াঁ। দ্বিতীয় বিয়ের দেনমোহরের টাকা সে জোগাড় করেছিল মাজুবিবির পাক করা নলেন গুড় বেচে। কিন্তু রসের মরসুমে দেখা গেল, নতুন বৌ ফুলবানুর হাতে মাজুর জাদু নেই। তার পাক দেওয়া গুড় বিকোতে চায় না হাটে। তত দিনে মাজুও আর এক জনকে নিকাহ করেছে। তবু দু’হাঁড়ি খেজুর রস নিয়ে শেষে তারই দ্বারস্থ হয় মোতালেফ— ‘জ্বাল দিয়া দুই সের গুড় বানাইয়া দেওয়ার জইন্যে’।

নরেন্দ্রনাথ মিত্র তাঁর অমর ‘রস’ গল্পে রেখে গিয়েছেন এই আলেখ্য। এখনও হয়তো কিছু ঘরে মোতালেফ আর মাজুরা আছেন, কিন্তু খেজুরের রসই যে বাড়ন্ত!

নিতান্ত অনাদরে বেড়ে ওঠা খেজুর গাছ নলেন গুড়ের জোগানদার। কিন্তু কখনও রাস্তা করতে তার ঘাড়ে কোপ পড়ে, কখনও ইটভাটার আঁচ জ্বালতে। রস জোগাবে কে?

কয়েক বছর আগেও নদিয়ার চর শম্ভুনগর বা নতুন শম্ভুনগরে কার্যত খেজুরের বন ছিল। গ্রামে পাকা রাস্তা করতে গিয়ে সে সব নিশ্চিহ্ন। ছবিটা মাজদিয়া, চাপড়া, কৃষ্ণগঞ্জ সর্বত্র এক। চূর্ণী, মাথাভাঙা, ইছামতী আর অসংখ্য বিল-বাঁওড়ে ঘেরা মাজদিয়া, আদিত্যপুর, বার্নপুর, গেদে, ফতেপুর, ছুটিপুর, ভাজনঘাট, মাটিয়ারির বিস্তীর্ণ অঞ্চল এখনও এ বঙ্গে নলেন গুড়ের প্রধান কেন্দ্র। কিন্তু বিগত কয়েক বছরে গাছের সংখ্যা অন্তত চল্লিশ থেকে পঁয়তাল্লিশ শতাংশ কমে গিয়েছে বলে আক্ষেপ প্রাক্তন কৃষি আধিকারিক নিশীথ দে-র। পলসন্ডার গুড় প্রস্তুতকারক আরমান শেখের খেদ, “লোককে খেজুর গাছ কাটতে দেখবেন, কিন্তু কোনও দিন দেখবেন না খেজুর গাছ বসানো হচ্ছে!’’

মুর্শিদাবাদের জেলা উদ্যানপালন আধিকারিক গৌতম রায়ের মতে, “এক দিকে গাছের সংখ্যা কমছে, অন্য দিকে গাছ থেকে রস সংগ্রহের পেশাতেও লোকজন কম আসছেন।” কথাটা অনেকাংশেই ঠিক। মাজদিয়ার হাট থেকে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে গোটা শীতকাল জুড়েই হরেক রকম গুড় যায়। কিন্তু আদিত্যপুরের শ্যামাপ্রসাদ বিশ্বাস, কেনারাম বিশ্বাস বা গোপাল বিশ্বাসেরা নলেন গুড়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন। তাঁদের কথায়, “বাপ-ঠাকুর্দার আমল থেকে গুড় তৈরি করে গেলাম। কিন্তু আমাদের ছেলেপিলেরা এ কাজ করবে না। কাকভোরে উঠে খেজুর গাছ বাওয়ার কথা ওরা ভাবতেই পারে না।”

ডোমকলের কুপিলার ইয়ারুদ্দিন মণ্ডল এক সময়ে নিজের আর অন্যের মিলিয়ে ৬০-৭০টি গাছ থেকে রস সংগ্রহ করতেন। কিন্তু এখন তা কমে ৩০টিতে দাঁড়িয়েছে। তিনি বলেন, “গাছ থেকে রস সংগ্রহ করা সোজা কাজ নয়। তাই অনেকেই এখন এ কাজ থেকে মুখ ফিরিয়েছে।”

তবে সে তো পরের কথা। গাছ থাকলে তবে তো রস সংগ্রহের প্রশ্ন। ডোমকলের শীতলনগরের উম্মর শেখ তো গাছের অভাবে গত চার-পাঁচ বছর রস সংগ্রহ বন্ধই করে দিয়েছেন। এখন তিনি দিনমজুরি করেন।

বাংলার নলেন গুড় নিয়ে এত লাফালাফি, কিন্তু সরকারি বৃক্ষরোপণ কর্মসূচিতে খেজুর চারা বিতরণ করা হয় না। গৌতমবাবু অবশ্য বলেন, ‘‘খেজুর রস ও নলেন গুড়ের ভাল চাহিদা আছে। খেজুর গাছও লাগানো যায় কি না, তা খতিয়ে দেখছি।’’ নদিয়ার সহ-কৃষি অধিকর্তা মনোরঞ্জন বিশ্বাসের মতে, “আধুনিক মিশ্রচাষ পদ্ধতিতে কৃষক তাঁর জমির আল বা উদ্বৃত্ত অংশে খেজুর গাছ বসালে লাভ বই ক্ষতি নেই!”

হুঁশ ফিরুক, দেরিতে হলেও। না হলে বাঙালির শীত পানসা হবে!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

nalen molasses molasses date tree
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE