Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪

লা-জবাব লাচ্চা, উনুন জ্বলছে দিনরাত

একফালি নতুন চাঁদ। এমনকী, চুল থেকে নখ নতুন। এর মানে ইদ। শুধু কী তাই? ইদ মানে আরও অন্য কিছু। বেহেস্তি স্বাদ আর বেহস্তি খুসবু ছাড়া ইদ জমে কোথায়? গরম দুধে জারিত হয়ে কাজু, কিসমিস, আখরোট আর হরেক খুসবুদার মসলার মিশেলে তৈরি সিমাই বা লাচ্চার স্বাদই তো সেই বেহস্ত।

তৈরি হচ্ছে লাচ্ছা। — অর্কপ্রভ চট্টোপাধ্যায়

তৈরি হচ্ছে লাচ্ছা। — অর্কপ্রভ চট্টোপাধ্যায়

অনল আবেদিন
বহরমপুর শেষ আপডেট: ০২ জুলাই ২০১৬ ০২:২০
Share: Save:

একফালি নতুন চাঁদ। এমনকী, চুল থেকে নখ নতুন। এর মানে ইদ।

শুধু কী তাই? ইদ মানে আরও অন্য কিছু। বেহেস্তি স্বাদ আর বেহস্তি খুসবু ছাড়া ইদ জমে কোথায়?

গরম দুধে জারিত হয়ে কাজু, কিসমিস, আখরোট আর হরেক খুসবুদার মসলার মিশেলে তৈরি সিমাই বা লাচ্চার স্বাদই তো সেই বেহস্ত। এতেই তো ইদের রসনা তৃপ্তি। লাচ্ছা বা সিমাই-এর সঙ্গে ইদের যোগ জল আর মাছ এর মতো। আলাদা করা যায় না কিছুতেই।

কবে থেকে কেউ জানে না, কিন্তু ইদের সঙ্গে সিমাই বা মতান্তরে সিমুই এবং লাচ্চার সর্ম্পক দীর্ঘদিনের। মরশুমি ফলের মতো বাজারে সাধারণত মাস খানেকের জন্য সিমাইয়ের আর্বিভাব ঘটে। মুর্শিদাবাদ জেলার অর্থনীতির উপরও তার প্রভাব পড়ে বেশ ভালই।

জেলার বিভিন্ন প্রান্তে সিমাই ও লাচ্চা তৈরির প্রচুর কারখানা গড়ে উঠেছে। জেলার কারখানার তৈরি সিমাই এবং লাচ্চা রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে যায়। ব্যাবসায়ীদের দেওয়া হিসাব অনুযায়ী রোজার এক মাসে মুর্শিদাবাদ জেলায় প্রায় ১০ কোটি টাকার ব্যবসা হয়। আর সেই ১০ কোটির মধ্যে ইদের আগের তিন দিনেই ব্যবসা হয় প্রায় ৭ কোটি টাকার। সিমাই তৈরিতে মাসখানেকর জন্য শ্রমিকদেরও লাভজনক মজুরির কাজ জোটে।

মূলত ময়দা দিয়ে সিমাই তৈরি করা হয়। তিন ধরণের সিমাই রয়েছে— লাচ্চা সিমাই, কাটি সিমাই ও জিরো সিমাই।

লাচ্চা সিমাই স্রেফ হাতে তৈরি করা হয়। ওই সিমাই-ই পামতেলে, ডালডায় অথবা ঘিয়ে ভাজা হয়। বহরমপুরের ফল ও সিমাই ব্যবসায়ী সুকুমার দে বলেন, “ঘিয়ে ভাজা হাত লাচ্চার মতো সুস্বাদু আর কোনও সিমুই নেই।” দুধে কাজু, কিসমিস, জয়িত্রী, চিনি দিয়ে উনুনে জ্বাল দিতে হয়। ঘন দুধের মিশ্রনে লাচ্চা সিমাই ডুবিয়ে দেওয়া হয়।

মিনিট কয়েকেই ম্যাজিক। সেই দুধের মিশ্রন শরীরে ধারণ করে লাচ্চা তখন যেন পূর্ণ যৌবনবতী। সামান্য গোলাপজল ছড়িয়ে সে যখন প্লেটে হাজির হয়— জুরি মেলা ভার সেই স্বাদের।

কাঠি সিমাই ও জিরো সিমাই মূলত ভুনা রান্না হয়। ভুনা মানে শুকনো। তবে কাঠি সিমাই লাচ্চার মতো রসালোও রান্না করা যায়। কাঠি ও জিরো— দু’ ধরণের সিমাই মেসিনে তৈরি করা হয়।

একদা সম্পন্ন মুসিলম পরিবারে সিমাই তৈরির জন্য কাঁসা পিতল দিয়ে তৈরি হাতে ঘোরানো মেশিন থাকত। রোজার মাসে সেই মেশিন বিভিন্ন বাড়িতে ঘুরে বেড়ায় সিমাই তৈরির জন্য। বাড়ির মহিলারা সেই মেশিনের হাতল হাতে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সিমাই তৈরি করে রোদে শুকোতেন।

বহরমপুর ব্লকের নওদাপাড়া গ্রামের সত্তোরোর্ধ মসিলন বেওয়া বলেন, ‘‘হাতে ঘোরানো পিতলের মেশিনেরও আগে মাটির হাঁড়ি উপুড় করে সরু সরু সিমুই তারি করতে হতো।’’ জেলার ধুলিয়ান, অরাঙ্গাবাদ, সমশেরগঞ্জ, বড়ঞার ডাকবাংলা, সালার, বেলডাঙা, ইসলামপুর, বালিরঘাট, দৌলতাবাদ ও বহরমপুরের উত্তরপাড়া, জমিদারি, হরিদাসমাটি, বৈরগাছির মতো এলাকাতেও সিমুই তৈরির কারখানা গড়ে উঠেছে। তবে অধিকাংশ কারখানাই অস্থায়ী। আয়ু মোটে এক বা দু’মাস।

রমজান মাস শুরুর আগে থেকে ইদের পরের কয়েকদিন। এ ছাড়া কুরবানির ইদের সময়ও মাসখানেক সিমাই-লাচ্চার চাহিদা হওয়ায় অস্থায়ী কারখানার কাঠের উনুনে দাউ দাউ আগুন জ্বলে ২৪ ঘন্টা।

খাগড়াঘাট স্টেশন এলাকার সিমাই কারখানার মালিক আক্কাশ শেখ বলেন, ‘‘সিমাই তৈরির জন্য প্রয়োজন দক্ষ ওস্তাদ (লাচ্চা শিল্পের নিজস্ব ভাষায়)। সেই ওস্তাদ মেলে এ জেলার সালারে, নয়তো বিহারে। তিনি বলেন, “সালার থেকে ১৫ জন শ্রমিক এসেছে। দিনরাত ২৪ ঘণ্টায় তাঁরা দৈনিক সাড়ে ৫ কুইন্টাল ময়দা থেকে ৮ কুইন্টাল লাচ্চা তৈরি করেন।’’

প্যাকেট বন্দি হয়ে সেই সিমুই মুর্শিদাবাদের সীমানা পার হয়ে চলে যাচ্ছে বীরভূম, নদিয়া-সহ বিভিন্ন জেলায়। বিশাল কড়াইয়ে ২৪ ঘণ্টা ফুটছে পামতেল, বা ডালডা। নিমেষে ভাজা হয়ে তৈরি হয়ে যাচ্ছে লাচ্চা সিমুই।

এ জেলার কারখানা থেকে অন্য জেলায় সিমুই যেমন রপ্তানি
হয়, তেমনই কলকাতা, সিউড়ি, সাঁইথিয়া থেকেও এ জেলায় সিমাই আমদানি হয়।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE