Advertisement
০৫ মে ২০২৪

রোজগার নেই ঘরে-বাইরে

হাত আছে, কাজ নেই। কেরলে রাজমিস্ত্রির ছেনি-কুরনি ফেলে রেখে ঘরে ফিরেছেন যুবক। কিন্তু এ কার ঘর? চেনা তাঁতের শব্দ কই? তাঁতও বন্ধ বুঝি? উঠোনের এক কোণে পাটকাঠির মাচার নীচে রান্নাঘর। চারদিক খোলা। কাঠের উনুনে কালো হাঁড়িতে ফুটছে ভাত।

সুস্মিত হালদার
শেষ আপডেট: ১৪ ডিসেম্বর ২০১৬ ০১:১৮
Share: Save:

হাত আছে, কাজ নেই।

কেরলে রাজমিস্ত্রির ছেনি-কুরনি ফেলে রেখে ঘরে ফিরেছেন যুবক।

কিন্তু এ কার ঘর? চেনা তাঁতের শব্দ কই? তাঁতও বন্ধ বুঝি?

উঠোনের এক কোণে পাটকাঠির মাচার নীচে রান্নাঘর। চারদিক খোলা। কাঠের উনুনে কালো হাঁড়িতে ফুটছে ভাত। উনুনের পাশে অ্যালুমিনিয়ামের গামলায় কোটা পালং আর বেগুন।

দুপুরের খাবার।

খানিক দূরে মাটির দাওয়ায় হেলান দিয়ে বিড়ি টানছিলেন বদর শেখ। চোখে-মুখে এক রাশ বিরক্তি। দিন দশেক হল কেরল থেকে প্রায় খালি হাতে বাড়ি ফিরেছেন। বাড়িতে স্ত্রী, দুই বাচ্চা, বৃদ্ধা মা, বোন।

কিন্তু না ফিরেই বা কী করবেন?

কেরলের পালঘাটে রাজমিস্ত্রির জোগাড়ের কাজ করতেন বদর। রোজ ৩৪০ টাকা। মাসে কমবেশি বিশ দিন কাজ মিলত। নোট বাতিলের পরে তা কমে আট-নয় দিনে এসে ঠেকে। তা-ও মজুরি দেওয়া হচ্ছিল পাঁচশো-হাজার টাকার নোটে পুরনো নোটে।

উনুনের সামনে বসে আঁচের দিকে চেয়ে ঠায় বসেছিলেন বদরের স্ত্রী ভাদু বিবি। বোধহয় ভাবছিলেন, হাঁড়িতে রাতে কী চড়বে? বাড়িতে বসে হাতে টানা তাঁত চালাতেন তিনি। বন্ধ তা-ও। মহাজন সুতো দিচ্ছেন না। তাঁদের এখন কাঁচা টাকার আকাল। বদর বলেন, “কেরলে কাজ নেই। এখানেও তাঁত বন্ধ। বউ বেকার হয়ে গিয়েছে। কোথায় যাব বলতে পারেন?”

শুধু কি বদর একা? শান্তিপুরের সূত্রাগড়ে তাঁর মতো বহু মজুর ঘরে ফিরেছেন, এখনও ফিরছেন অনেকে।

দিন দশেক আগেই ফিরে এসেছেন লতিফ মন্ডল। কেরলে ছাদ ঢালাই শ্রমিকের কাজ করতেন তিনি। দিনে পাঁচশো টাকা মজুরি। তাঁর বাড়িতেও চলছিল তিনটে তাঁত। মা, স্ত্রী আর বোন মিলে চালাতেন। ভেবেছিলেন বছরখানেক পরে নিজের ঘরেই ছাদ ঢালাই দেবেন। কোথায় কী?

তিক্ত গলায় লতিফ বলেন, “প্রায় দু’সপ্তাহ কাজ না পেয়ে বসে থাকার পরে মোটে দু’হাজার টাকা হাতে নিয়ে বাড়ি ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নিলাম।” এই ক’দিনে একটা জোগাড়ের কাজও জোটাতে পারেননি তিনি। তিন দিন আগে মহাজনের হাতে-পায়ে ধরে একটা কাপড় বোনার সুতো নিয়ে এসেছেন। সেটা বুনছে বোন। মজুরি একশো টাকা। আপাতত সেই দিকেই তাকিয়ে ছ’টা পেট।

এলাকার পরিচিত মহাজন মিলন বিদ্যান্ত বলছেন, “টাকার অভাবে আমরাই সুতো কিনতে পারছি না। ওদের দেব কী করে? তা ছাড়া, কাপড় বানালেও তা কিনবে কে? বাজারের অবস্থা খুব খারাপ।”

সুতির হরিপুরের হাবিবুর রহমান বরাবরই রাজমিস্ত্রির কাজ করতে যান মুম্বই। তিনিও ফিরে এসেছেন গ্রামে। স্ত্রী আলিয়ারা বিবি বিড়ি বাঁধতেন। সে কাজও গিয়েছে। এর মধ্যেই ক্ষীণ আশা, সোমবার তাঁর বিড়ি কারখানা ফের খুলেছে। জঙ্গিপুরের নবকান্তপুরে জাবেদ মিয়াঁদাদ রাজমিস্ত্রির কাজ করছিলেন আসানসোলে। তিনিও ফিরেছেন। তাঁর স্ত্রী জাহানারা বিবিও বিড়ির কাজ হারিয়ে বেকার বসে।

ধুলিয়ানের খরবোনায় ফিরেছেন মোস্তাক শেখ। মুম্বইয়ে কাগজের বাক্স তৈরির কারখানায় কাজ করতেন। তা দিন পনেরো আগে বন্ধ হয়ে গিয়েছে। মোস্তাক কিন্তু টাকা নেই তারা মজুরি দেয়নি। তাই খালি হাতেই ফিরতে হয়েছে। অবিবাহিত মোস্তাকের বাবা অসুস্থ। ঘরে চার বোন আর মা। সবাই বিড়ির কাজ হারিয়ে বেকার।

তিন মাস আগে রাজমিস্ত্রির কাজ নিয়ে চেন্নাই যান ভগবানগোলার শ্যামপুর নতুনপাড়ার ইসরাইল শেখ। ফিরে এসেছেন। তাঁর কথায়, ‘‘নোট বাতিলের পরেই ঠিকাদার খুচরো নোটের অভাবে কাজ বন্ধ করে দেয়। ভগবোনাগোলা থেকে আমরা যে ক’জন গিয়েছিলাম, সকলেরই কাজ চলে যায়। দু’সপ্তাহ বসেও ছিলাম। তার পর বাধ্য হয়ে ফিরে এসেছি।’’

ইসরাইলের মতোই রাজমিস্ত্রি ও দিনমজুরের কাজ নিয়ে দিল্লি, মুম্বই, চেন্নাই, হায়দরাবাদ মন্টু শেখ, কালু শেখ, টুটুল শেখ, ইয়ামিন শেখ, বিডিও শেখদের মতো অনেকে। ঘরে ফিরে এখন কেউ নিজের জমিতে, কেউ পরের জমিতে কাজ করছেন। রংমিস্ত্রির কাজে মুম্বই গিয়েছিলেন নবগ্রামের রসুলপুরের মহসিন শেখ। মাস তিনেক আগে বাড়ি ফিরে স্ত্রী-সন্তানদেরও নিয়ে গিয়েছিলেন। কাজ হারিয়ে সপরিবার ফিরে এসেছেন।

সূত্রাগড়ের মানিকনগর পাড়ায় আকবর মণ্ডলের বাড়ির দাওয়ায় বসে ভ্যাঁ-ভ্যাঁ করে কাঁদছিল একটা বাচ্চা। নাক দিয়ে সিকনি গড়াচ্ছে। “বাচ্চাটা খিদেয় কাঁদলে প্রচণ্ড কষ্ট হয়, জানেন”— বলতে বলতে গলা বুজে আসে আকবরের। তিনিও কেরলে জোগাড়ের কাজ করতেন। তাঁদের তাঁত নেই। মা আর স্ত্রী সুতোর নলি পাকানোর কাজ করতেন। দিনে ৫০ টাকা মত আয় হত। এখন বন্ধ।

ছাদ ঢালাইয়ের কাজ হারিয়ে ফেরা মসিবুল শেখ বলেন, “তাঁতের কাজে পয়সা নেই বলেই আমরা কেরলে গিয়েছিলাম। এখন দু’দিকই গিয়েছে।” চলছে কী ভাবে? “আত্মীয়দের কাছে হাত পেতে আর মুদির দোকানে ধার করে। জানি না এ ভাবে কত দিন চালাতে পারব,” বলছেন আকবর।

(সহ প্রতিবেদন: শুভাশিস সৈয়দ ও বিমান হাজরা)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

demonetisation no work
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE