Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

হারাচ্ছে নদীকূল, নদীকান্ত, নদীগর্ভ...

সেই কবে ধনপতি সদাগর সিংহল যাত্রার সময় ‘নয় দীয়ার’ নদী তীরে রাত্রিবাস করার সময়ে প্রাচীন এই জনপদের মানুষের মুখেই শুনেছিলেন তাঁদের প্রিয় নদী হারিয়ে ফেলার গল্প। জেনেছিলেন একবার নদী হারানোর বেদনা থেকে কেমন করে নদীকে সন্তানের মতো স্নেহে লালন করার ইচ্ছার জন্ম হয়েছিল নদিয়াবাসীর মনে। আরও শুনেছিলেন, সংখ্যাহীন নদীস্রোত থেকেই কী ভাবে এই জায়গার নাম নদিয়া। নদিয়া ও মুর্শিদাবাদের সেই নদীগুলির খবর নিলেন দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়।

নবদ্বীপের কাছে গঙ্গা। ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য।

নবদ্বীপের কাছে গঙ্গা। ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য।

শেষ আপডেট: ২৫ জুন ২০১৬ ০৭:২৫
Share: Save:

“...হারিয়ে যায় একজনা, একটি কুমারী-অলকানন্দা। দু-কুলের পাখি সুর হারায়, দু-পাড়ের বন স্বর হারায়, দু-তীরের দেবালয় মন্ত্রধ্বনি হারায়, দু-পাশের জনপদ গীত হারায়।... কিন্তু গাঙ্গনি-খড়িয়া-জলঙ্গি হারাতে চায় না জনপদবাসী। ধান্যগাছার বেড়িতে বাঁধে মাথাভাঙ্গা, চূর্ণি, ইছামতি, ভৈরবে। যেদিকে চোখ যায় যেন জেগে থাকে নদীকুল, নদীগর্ভ, নদীকান্ত, নদীতট, নদীপথ।” (ধনপতির সিংহল যাত্রা - রামকুমার মুখোপাধ্যায়)

গঙ্গা

প্রবাহ পথ: মূল গঙ্গা নদীর উৎসস্থল ভাগীরথী ও অলকানন্দা নদীর সঙ্গমস্থল। ভাগীরথীকেই গঙ্গার মূলপ্রবাহ বলে মনে করা হয়। যদিও অলকানন্দা নদীটি দীর্ঘতর। ভাগীরথীর উৎস গোমুখের গঙ্গোত্রী হিমবাহ। এই রাজ্যে প্রবেশের পরে বিরাট এই নদী পদ্মা ও গঙ্গায় দু’ভাগে ভাগ হয়েছে। শেষ পর্যন্ত মিশেছে বঙ্গোপসাগরে।

বর্তমান অবস্থা: ভাগীরথীর উৎস মুখ ফানেলের মতো। জোয়ারের সময় চার ঘণ্টায় যে পরিমাণ জল ও পলি ঢোকে, আট ঘণ্টায় সেই পরিমাণ জল ধীরে ধীরে নামে বলে জানাচ্ছেন নদী বিশেষজ্ঞেরা। তাই নদীখাতের গভীরতা ক্রমশ কমছে। নদীতে জোয়ার ভাঁটা খেলা করে বলে স্রোতের চক্রাকারে পরিবর্তন ঘটে। গঙ্গা প্রতি বছর ৮০ কোটি টন পলি বয়ে আনে। ফরাক্কা বাঁধ তৈরির পর নদী বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, বহরমপুরের কাছে ভাগীরথীর জলস্তর উঠে যায় ১১ মিটার, নবদ্বীপের কাছে ৯ মিটার। স্বভাবতই বন্যার সময় জলঙ্গী তার বয়ে আনা জল ভাগীরথীতে ফেলতে পারে না। নদী বিজ্ঞানে তাকে বলে ‘হাইড্রলিক ড্যাম’। এক দিকে, জলঙ্গীর চাপ, অন্য দিকে কাটোয়ার কাছে অজয়ের চাপ মিলে ভাঙন তীব্র করে। মুর্শিদাবাদে জঙ্গিপুর মহকুমায় ভাঙন বেশ তীব্র। অতিরিক্ত বৃষ্টি হলে গঙ্গার জল ধরে রাখার কোনও ব্যবস্থা নেই। ফরাক্কা থেকে জল ছাড়লে তা সরাসরি ধাক্কা দেয় আখেরিগঞ্জ, টলটলিতে। নদীর জল যখন বাড়ে, তা প্রবেশ করে বালির স্তরে। জল নামার সময় বালি টেনে নেয়। পাগলা, বাঁশলৈ, মাধবজানি, কালজানি, গুমানি নদীর অতিরিক্ত জল ধরে রাখার ব্যবস্থা করা দরকার। সেই সঙ্গে, গঙ্গাদূষণ শুধুমাত্র গঙ্গাতীরে বসবাসকারী কয়েক কোটি ভারতীয়েরই ক্ষতি করছে না, করছে ১৪০টি মাছের প্রজাতি, ৯০টি উভচর প্রাণীর প্রজাতি ও ভারতের জাতীয় জলচর প্রাণী গাঙ্গেয় শুশুকের পক্ষেও তা ক্ষতিকারক হয়ে উঠছে।

ইছামতী

প্রবাহ পথ: ভারত ও বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত আন্তঃসীমান্ত নদী। দৈর্ঘ্য ৩৩৪ কিলোমিটার। নদীটির এখন একাধিক অংশ। সব চেয়ে দীর্ঘ অংশটি পদ্মার একটি শাখানদী, মাথাভাঙা থেকে প্রবাহিত হয় এবং ২০৮ কিমি প্রবাহিত হবার পর উত্তর ২৪ পরগণা‎র হাসনাবাদে এবং অন্য দিকে বাংলাদেশের দেবহাটার কাছে কালিন্দী নদীর সাথে যুক্ত হয়। অন্য একটি অংশ এক সময়ে পশ্চিম ঢাকার প্রধান নদী বলে পরিচিত ছিল এবং শেষ অংশটি দিনাজপুরের ইছামতী। অনেক নদী বিশেষজ্ঞ মনে করেন প্রাচীনকালে তিনটি ইছামতী নদীই অভিন্ন ছিল। নদীটিতে পাঁচটি তীর্থযাত্রার ঘাট -তীর্থঘাট, আগলা, শোলপুর, বরুণীঘাট ও যোগিনীঘাট রয়েছে যা স্থানীয়ভাবে পঞ্চতীর্থ ঘাট নামে পরিচিত।

বর্তমান অবস্থা: নদীটি বর্তমানে পলি জমে ভরাট হয়ে যাবার সমস্যার সম্মুখীন। শুখা মরসুমে এটি কেবল সরু পথে প্রবাহিত হয়,আর বর্ষায় বন্যার কবলে পড়ে। যেহেতু ইছামতীর গর্ভ মাথাভাঙা থেকে ১৪ ফুট বেশি উঁচু, আবার চূর্ণী মাথাভাঙা থেকে ছয় ইঞ্চি নিচু তাই শুখা মরসুমে মাথাভাঙার জলের উচ্চতা পদ্মার থেকে বেশি থাকে এবং এর ফলে এ সময়ে ইছামতীতে জল প্রবেশ করতে পারে না। এ ছাড়া রেললাইনের জন্য তৈরি ওভারব্রিজের গার্ড ওয়াল নদীতে তৈরি করার জন্য নদী গর্ভ পলি পড়ে বুজে যাচ্ছে। পাশাপাশি নদী সংলগ্ন এলাকাটি শিল্পবর্জ্য ও জনগণের নদীর জমি দখলের কারণেও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। নিকাশি নালার অভাব, অবৈধ দখল, আর্সেনিকসহ অন্যান্য কারণে নদীর দুষিত জল জলজ উদ্ভিদ ও প্রাণীদের পক্ষে প্রাণঘাতী হয়ে উঠেছে।

মাথাভাঙা

প্রবাহ পথ: এই নদী বাংলাদেশের কুষ্টিয়া জেলায় পদ্মা থেকে উত্পত্তি লাভ করেছে। মাজদিয়ার কাছে দ্বিখণ্ডিত হয়ে দুটি নদী ইছামতী ও চূর্ণী উৎ‌পন্ন করে। ভারতে ১৯.৫ কিলোমিটার তীর্যকভাবে অতিক্রম করে, ইছামতী মুবারকপুরের কাছে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। এটি বাংলাদেশে ৩৫.৫ কিলোমিটার প্রবাহিত হয় এবং আবারও ভারতে প্রবেশ করে দত্তফুলিয়া দিয়ে। নদীটি বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ২১ কিলোমিটার দীর্ঘ আন্তর্জাতিক সীমারেখা তৈরি করেছে। শেষে এটি বঙ্গোপসাগরে মিশেছে।

বর্তমান অবস্থা: ভৈরব এক সময় গঙ্গা থেকে প্রবাহিত হত, এটি তখন জলঙ্গির বর্তমান তীরের মধ্যদিয়ে আরো পূর্বদিকে প্রবাহিত হত। ভৈরব এখন আর তেমন জীবন্ত নেই। মাথাভাঙা, জলঙ্গির একটি নতুন জলস্রোত। কিছু দিন আগে পর্যন্ত নদীটি হুগলির সঙ্গে যোগসূত্র ঘটায় চূর্ণী নদীর মাধ্যমে। মাথাভাঙার জল আগে মূলত কুমারা, চিত্রা, ভৈরব ও ইছামতী দিয়ে প্রবাহিত হত। প্রসঙ্গত এই অঞ্চলের নদীগুলো একদা দক্ষিণ-পূর্ব অভিমুখে প্রবাহিত হত, কিন্তু পরে জলঙ্গি ও মাথাভাঙা দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে প্রবাহিত হয়ে থাকে।

ভৈরব

প্রবাহ পথ: এই নদটি তার যাত্রাপথে বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন নামে পরিচিত। কালীগঞ্জ হতে কৈখালি পর্যন্ত নদীটির নাম 'কালিন্দি'। এর পর এটি 'রায়মঙ্গল'। তারপর নদীটি দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায়। পশ্চিমের অংশটি 'হরিভাঙা', এবং পূর্বেরটি 'ভৈরব' নামে প্রবাহিত হয়। কৈখালির পরে নদটি 'খুলনা-ইছামতি' নামে প্রবাহিত হয়। দক্ষিণের অংশটি 'রায়মঙ্গল-হরিভাঙা' নামে পরিচিত। ভৈরব নদের মোট দৈর্ঘ্য ২৫০ কিলোমিটার।

বর্তমান অবস্থা: ক্রমশ শুকিয়ে আসছে ভৈরব। বাংলাদেশের যশোর জেলার পার হলেই ভৈরব আর নাব্য থাকে না। বর্ষার মরসুমে এটি নাব্য থাকলেও শুখা মরসুমে শুকিয়ে যায়। তবে এই জলপ্রবাহের নীচের অংশে জোয়ার-ভাঁটা হয়। এবং নাব্যতা সারা বছর বজায় থাকে।

কেন হারাচ্ছে নদী

এই প্রসঙ্গে বিশেষজ্ঞ জয়া মিত্রের বক্তব্য, প্রবহমান জলধারাকেই আমরা নদী বলি। বয়ে চলাই নদীর স্বাভাবিক ধর্ম। অথচ নদীর সেই প্রবাহকে স্তব্ধ করে দেওয়ার জন্য যা যা করণীয়, তার সবই আমরা করে চলেছি। নদীর প্রবাহ পথে বাঁধ নির্মাণ সবার আগে দায়ী। নদীর বুকে পলি জমে ক্রমশ অগভীর হচ্ছে খাত। তারপরই দায়ী কৃষিজমিতে আরও ফলনের জন্য লক্ষ লক্ষ পাম্প বসিয়ে ভূগর্ভস্থ জল টেনে নেওয়া। এই ভূগর্ভস্থ জল নদীর স্বাভাবিক পুষ্টি জোগাতো। যার অভাবে নদীর মৃত্যু অনিবার্য হয়ে উঠছে।

প্রতিকার

বাঁধ নির্মাণ নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে। নদীর দুপাশে অনেকটা জমি ঘাসযুক্ত জমি ছেড়ে রাখতে হবে।মাটির জলে পাম্প দিয়ে টেনে তোলা বন্ধ করতে হবে। প্রচুর পরিমাণে পুকুর কাটতে হবে। খালবিল জলাভূমিকে গুরুত্ব দিয়ে টিকিয়ে রাখতে হবে।ড্রেজিং নামের অবাস্তব এবং অবৈজ্ঞানিক একটি কল্পনা থেকে বেরিয়ে এসে উপরের পথগুলি অনুসরণে সচেষ্ট হলেই সার্বিক ভাবে নদীমঙ্গল করা সম্ভব হবে।

সমাপ্ত

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

ichamati river Pollution
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE