গোবিন্দপুরে ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক জুড়ে এমনই বড়-বড় গর্ত।—নিজস্ব চিত্র।
বর্ষা এখনও সেভাবে শুরু হয়নি। এরই মধ্যে বেহাল হয়ে পড়েছে ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক। কোথাও হাঁটু সমান গর্ত, কোথাও বা পিচ উঠে মাটি বেড়িয়ে পড়েছে। পুরোদমে বর্ষা শুরু হলে পরিস্থিতি যে আরও ভয়ানক হয়ে উঠবে তা মনে করে রীতিমতো শিউরে উঠছেন বাস-লরির চালকরা। সেই আশঙ্কা খুব একটা অমূলক বলে মনে করছেন না স্বয়ং জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষও।
কৃষ্ণনগরের নবদ্বীপ মোড়ের কাছে ব্রিজের নিচ থেকে শুরু করে বারাসতের দিকে রাস্তার অবস্থা ক্রমশ খারাপ হচ্ছে। ভাতজাংলা, কালীরহাট, সেনপুর, দিগনগর, বেলেডাঙা মোড়, বাগদিয়া, গোবিন্দপুর বাজার, শান্তিপুর বাইপাস, ফুলিয়া, বিনপুর, হবিবপুর, পাঁচপোতা, বাগানবাড়ি, ঘাটিগাছা, চাকদহ বাজারের কাছে কল্যাণী মোড় এলাকায় রাস্তার উপরে বড়বড় গর্ত। এই বৃষ্টিতে বিটুমিনাসের কাজ সম্ভব নয়। খুব বেশি হলে পাথর দিয়ে রাস্তার গর্ত তাপ্পি মারা হতে পারে। কিন্তু ভারী বর্ষায় তাপ্পি বেশি দিন থাকে না।
এই অবস্থায় ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক দিয়ে বিভিন্ন রুটের বাসের সংখ্যা কমছে। নদিয়া জেলার বাস মালিক সমিতির সম্পাদক অশোক ঘোষ বলেন, ‘‘কৃষ্ণনগর থেকে কলকাতার দিকে আমাদের জেলার দূরপাল্লা ও স্থানীয় রুটে ১০৬টি বাস চলে। রাস্তার অবস্থা এতটাই বেহাল যে প্রায় ৪০টির মতো বাস বন্ধ হয়ে আছে। কারণ এই রাস্তায় চালালে বাসের যেমন ক্ষতি তেমনই বিপদের সম্ভাবনাও থেকে যায়। পুরোপুরি বর্ষা নামলে রাস্তার অবস্থা আরও খারাপ হবে। তখন কিন্তু আরও অনেক বাস বন্ধ হয়ে যাবে।’’
লরি মালিকরাও জানাচ্ছেন ভাঙচোরা রাস্তায় লরির যন্ত্রাংশের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। তবে সব চেয়ে সমস্যায় পড়েছেন ছোট গাড়ির মালিকরা। রাস্তায় বড়-বড় গর্তে পড়ে মাঝে-মধ্যেই দুর্ঘটনা ঘটছে। কৃষ্ণনগরের বলরাম জোয়ারদার বলেন, ‘‘যা অবস্থা তাতে আড়াই ঘণ্টার রাস্তা এখন সময় লাগছে প্রায় চার ঘণ্টা। বাধ্য হয়েই অনেকে নবদ্বীপ, কালনা হয়ে কলকাতায় যাচ্ছেন। তাতে খরচ পড়ছে বেশি। কিন্তু ৩৪ নম্বরে রাস্তার যা অবস্থা তাতে একবার কলকাতা যাতায়াত করলেই গাড়ির কোনও না কোনও যন্ত্রাংশ খারাপ হয়ে যাচ্ছে।’’
জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, রাস্তা সম্প্রসারণের কাজ চলছে এখন। সেই কাজের দায়িত্বে থাকা সংস্থাকেই জাতীয় সড়ক মেরামতি করতে হবে। কয়েক মাস আগে তারা একপ্রস্থ সংস্কার কাজ করেওছে। বর্ষা শেষ না হলে এই মুহূর্তে বিটুমিনাস দিয়ে কাজ করা সম্ভব নয়।
তাহলে?
৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষের প্রকল্প আধিকারিক তীর্থ রায় বলেন, “বহন ক্ষমতার অতিরিক্ত গাড়ি চলে এই রাস্তায়। তাই সারানোর কিছু দিনের মধ্যেই আবার খারাপ হয়ে যায়। তার উপরে অনেক জায়গায় নিকাশি ব্যবস্থা না থাকার কারণে রাস্তায় জল জমে গর্ত হয়ে যায়। চার লেনের পাকাপোক্ত রাস্তা না বানালে এর সমাধান নেই।”
রাস্তা সম্প্রসারণের কাজে দেরি হচ্ছে কেন?
জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষ জানাচ্ছেন, নদিয়া জেলায় দু’টি ভাগে কাজ হচ্ছে। কৃষ্ণনগর থেকে পলাশি পর্যন্ত ‘প্যাকেজ-টু’ তে সাড়ে ৪৯ কিলোমিটার রাস্তা তৈরি হচ্ছে। তার মধ্যে ৪৭ কিলোমিটার রাস্তা অধিগ্রহণ করে জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষকে হস্তান্তর করে দিয়েছে নদিয়া জেলা প্রশাসন। এর মধ্যে ৪০ কিলোমিটার রাস্তার কাজ প্রায় শেষ। কিন্তু কৃষ্ণনগর থেকে বড় জাগুলিয়া পর্যন্ত প্যাকেজ ওয়ানের প্রায় সাড়ে ৫৬ কিলোমিটারের মধ্যে এখনও পর্যন্ত মাত্র ২৭ কিলোমিটার রাস্তার দু’পাশের জমি জাতীয় সড়ক কতৃর্পক্ষের হাতে তুলে দিতে পেরেছে জেলা প্রশাসন।
নদিয়ার জেলাশাসক পি বি সালিম বলেন, ‘‘একমাত্র গোবিন্দপুর মৌজা ছাড়া বাকি সব ক’টি মৌজা সমীক্ষা করে এস্টিমেট বানিয়ে তা জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছি। কিন্তু এখনও পর্যন্ত ২৬টি মৌজার টাকা আমরা পাইনি। জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষ আমাদের টাকা দিয়ে দিলেই আমরা ওই মৌজাগুলির জমি অধিগ্রহণ করে তা জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষের হাতে তুলে দিতে পারব।’’
কেন টাকা দেওয়া হচ্ছে না?
তীর্থবাবু বলেন, ‘‘জেলা প্রশাসনের হিসাবে জমির যে মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে তা সরকারি নির্দেশাবলি মেনে নয়। সেই কারণে আমরা এখনও ওই মৌজাগুলির টাকা দিইনি। বিষয়টি নিয়ে জেলা প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনা চলছে।’’ জেলাশাসক অবশ্য বলেন, ‘‘আমরা কিন্তু সুপ্রিমকোর্ট ও হাইকোর্টের নির্দেশ মেনেই জমির দাম নির্ধারণ করেছি। আলোচনা চলছে। আশা করছি সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।’’
এ দিকে, গোবিন্দপুর মৌজায় সমীক্ষাটুকুও করা যায়নি এখনও। অথচ, কৃষ্ণনগর থেকে বড় জাগুলিয়ার মধ্যে ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়কের সব চেয়ে বিপজ্জনক অবস্থা শান্তিপুরের এই গোবিন্দপুর এলাকায়। গোবিন্দপুর বাজারে একাধিক বড়-বড় গর্ত। পিচ এতটাই উঠে গিয়েছে যে তলা থেকে মাটি বেরিয়ে গিয়েছে। ধুলোয় ভরে গিয়েছে চার পাশ। রাস্তা সংস্কারের দাবিতে এই এলাকার মানুষ একাধিকবার পথ অবরোধ করেছেন। কিন্তু ২০০৮-০৯ সালে জাতীয় সড়ক সম্প্রসারণের জন্য জমি অধিগ্রহণের নোটিফিকেশন জারি করা হলেও এখনও পর্যন্ত অধিগ্রহণ তো দূরের কথা জমির সমীক্ষা পর্যন্ত করতে দেননি এলাকার মানুষ।
জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গিয়েছে, এই এলাকায় শান্তিপুর-কৃষ্ণনগর শাখার রেললাইন চলে গিয়েছে। ফলে ফ্লাইওভার তৈরি করতে হবে। জাতীয় সড়কে বাঁক থাকায় ফ্লাইওভার করার জন্য গ্রামের ভিতরের দিকে কিছু জমি অধিগ্রহণ করা দরকার। ভাঙা পড়বে বেশ কিছু বাড়িও। এই প্রেক্ষিতে এলাকার বাসিন্দাদের দাবি, ‘কমার্শিয়াল’ হিসাবে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে জমির। তা নিয়ে জটিলতার জেরে এখনও পর্যন্ত ওই মৌজায় সার্ভে পর্যন্ত করতে দেননি এলাকার বাসিন্দারা। অতিরিক্ত জেলাশাসক দেবাশিস সরকার বলেন, ‘‘আমরা গোবিন্দপুর এলাকার মানুষের সঙ্গে একাধিকবার আলোচনায় বসেছি। আলোচনার মাধ্যমেই সমস্যার সমাধান করব।’’
ক্ষতিপূরণের টাকার অঙ্ক নিয়ে ক্ষোভ-বিক্ষোভ অবশ্য রয়েছে অন্য মৌজাতেও। এই নিয়ে মামলা-মোকদ্দমাও চলছে। এরই মধ্যে জমি জটিলতা নিয়ে শুরু হয়েছে রাজনৈতিক চাপান-উতোর। নদিয়ায় সিপিএমের জেলা সম্পাদক সুমিত দে বলেন, ‘‘আজকের শাসকদল বিরোধীদলে থাকার সময় জাতীয় সড়ক সম্প্রসারণের জমি অধিগ্রহণের বিষয়ে এলাকার মানুষ ও ব্যবসায়ীদের ক্ষেপিয়ে তুলেছিল রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির জন্য। তারই ধারাবাহিকতা চলছে। তৃণমূল তার অবস্থান বদলে ফেললেও মানুষগুলো একই জায়গায় থেকে গিয়েছে।’’ আর তৃণমূলের জেলার কার্যকরী সভাপতি অজয় দে বলেন, ‘‘আমরা উন্নয়ন চাই, কিন্তু কাউকে জোর করে উচ্ছেদ করে নয়। আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করছি। সিপিএম কোনও দিনই উন্নয়ন চায়নি। চাইলে রাজ্যটার হাল এমন এত না।’’
রাজ্যের হাল শুধরেছে কি না জানা নেই, তবে রাস্তার হাল যে শোধরায়নি, এই বর্ষায় স্পষ্ট।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy