গ্রাম পঞ্চায়েতের তরফে দেওয়া হয়েছে নোটিস।—নিজস্ব চিত্র
ঘটা করে আয়োজিত হয়েছে আলোচনা সভা। স্থানীয় ও জেলা প্রশাসনের তরফে শোনানো হয়েছে নানা পরিকল্পনার কথা। তৈরি হয়েছে নদী বাঁচাও কমিটি। পণ করা হয়েছে, যে ভাবেই হোক নদীকে বাঁচাতেই হবে। অথচ বাস্তব বলছে, কিছুই হয়নি। চোখের সামনে একটু একটু করে মরে যাচ্ছে করিমপুরের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া জলঙ্গি নদী। অথচ নদী বিশেষজ্ঞরা সাফ জানাচ্ছেন, নদী মরে যাওয়ার পিছনে যেমন ভূতাত্ত্বিক কিছু কারণ রয়েছে, তেমনই নদীকে মেরে ফেলার পিছনে মানুষের ‘অবদানও’ কিছু কম নয়।
যে জলঙ্গির জলের উপরে একসময় নির্ভর করত এলাকার কৃষিকাজ, এখন করিমপুরের সেই নদীই হয়ে উঠেছে কৃষিজমি। কোনও নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে কোথাও কোথাও নদীর বুকেই তৈরি হচ্ছে বসত বাড়ি। আর বেআইনি ভাবে গজিয়ে ওঠা অজস্র ইটভাটার সৌজন্যে নদীর বুক খুঁড়ে মাটি মাফিয়াদের তান্ডব এখন গা সওয়া হয়ে গিয়েছে সকলের। অথচ কোনও অজ্ঞাত কারণে প্রশাসন থেকে শুরু করে রাজনীতির কারবারিরা এই নদীর বিষয়ে নির্বিকার! করিমপুরে গত পঞ্চায়েত কিংবা লোকসভা নির্বাচনে প্রচারে বেরিয়ে সব রাজনৈতিক দলগুলোর প্রচারে উঠে এসেছে স্থানীয় সমস্যার সাতকাহন। অথচ সেই সব সমস্যার ভিড়ে নদী ছিল একেবারেই ব্রাত্য।
কেন? নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক করিমপুরের এক বাসিন্দা জানান, যার যেখানে যেমন ক্ষমতা তেমন ভাবেই দখল হয়ে যাচ্ছে নদী। করিমপুর এলাকাতেই কোথাও নদীর উপরে মাটি ফেলে তৈরি হয়েছে রাস্তা। কোথাও অর্ধ সমাপ্ত সেতুর নীচে নদীর উপরে ফেলে রাখা হয়েছে মাটি। যখন যে রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় এসেছে তখন তাদের মদতেই নদী দখল করেছে কিছু মানুষ। পাইয়ে দেওয়া রাজনীতিতে নদীকে ব্যবহার করা হচ্ছে ভোটের স্বার্থেই। আর সেই কারণেই নির্বাচনের প্রচারে নদী নিয়ে টুঁ শব্দ করে না ডান বাম কোনও পক্ষ। নদী বিশেষজ্ঞ কল্যাণ রুদ্র বলছেন, “এটাই তো স্বাভাবিক। নদী তো আর ভোটার নয়। কিন্তু নদীর বুকে যাঁরা বাড়ি কিংবা চাষ-আবাদ করছেন তাঁরা ভোটার। ফলে নদী নিয়ে সরব হলে ভোট কমবে বই বাড়বে না।’’
অথচ একটা সময় করিমপুরে এই জলঙ্গির অবস্থা এমন ছিল না। দু’ দশক আগেও এই নদীতে সারাবছর জল থাকত। সেচের জল কিংবা মাছ নিয়ে ভাবতে হত না কৃষিজীবী ও মৎসজীবীদের। বিজয়া দশমীতে করিমপুরে জলঙ্গি নদীর উপরে নৌকা বাইচ আজও এলাকার মানুষের স্মৃতি থেকে মুছে যায়নি। কিন্তু ভূতাত্ত্বিক কিছু কারণের পাশাপাশি নদীর উপর মানুষের ক্রমাগত অত্যাচারের ফলে জলঙ্গির সেই আগের অবস্থা এখন আর নেই। করিমপুরে এখনও পুরসভায় উন্নীত হয়নি। ফলে নোংরা-আবর্জনা ফেলার নির্দিষ্ট কোনও ব্যবস্থা এ শহরে এখনও গড়ে ওঠেনি। কিন্তু তাতে অবশ্য স্থানীয় বাসিন্দারা মোটেই চিন্তিত নন। নদীকেই ডাস্টবিন হিসাবে বেছে নিয়েছেন ‘সচেতন’ বাসিন্দারা! এলাকার বহু পুজো উদ্যোক্তাদেরও আক্ষেপ, “একটা সময় নদীতে এত জল থাকত যে বিসর্জন নিয়ে ভাবতে হত না। আর এখন তো বোধনের আগেই আমাদের বিসর্জন নিয়ে ভাবতে হয়।”
সেই প্রসঙ্গ টেনে কল্যাণবাবু বলছেন, “সমস্যা তো এখানেই। নদী আমাদের সব প্রয়োজন মেটাবে। অথচ নদীকে বাঁচিয়ে রাখতে আমরা কেউই কিছু করব না। এটা তো হতে পারে না। ভারতবর্ষ নদী মাতৃক দেশ। অথচ আমাদের দেশে কোন নদী মন্ত্রী নেই আজও। সেই অর্থে বলতে গেলে নদী কার্যত অভিভাবকহীন। আমাদের দেশে নদীর উপরে যে ভাবে অত্যাচার করা হয় পৃথিবীর কোনও সভ্য দেশে তা হয় না।’’
কল্যাণবাবু বলেন, “গত কয়েক শতাব্দীতে বদ্বীপ যত পূর্ব দিকে হেলে পড়েছে, পদ্মার ঢালও ততটাই বেড়ে গিয়েছে। ফলে পদ্মার খাত ক্রমশ গভীর হওয়ায় শাখানদীগুলো বর্ষাকাল ছাড়া পদ্মা থেকে জল পায় না। এ দিকে জলঙ্গির উৎসমুখও বন্ধ হয়ে গিয়েছে বহু দিন আগে। ফলে জলঙ্গি নদীর এখন ভরসা বলতে বৃষ্টি, ভৈরবের জল ও মাটির নীচের জল। প্রতিনিয়ত অত্যাচারের ফলে নদীর বহমানতার পাশাপাশি দূষিত হচ্ছে নদীর জল। অথচ বর্ষার সময় এই নদীগুলোই কিন্তু অতিরিক্ত জল বহন করে বন্যার হাত থেকে জনপদকে বাঁচায়। নদী নিয়ে যদি আমরা এখনও সচেতন না হই তাহলে ফল কিন্তু মারাত্মক হতে পারে।’’
তেহট্টের মহকুমাশাসক অর্ণব চট্টোপাধ্যায় বলেন, “জলঙ্গি নদীর অবস্থা সত্যিই করুণ। নদীর বহু জায়গা আবর্জনায় ভরে গিয়েছে। নদীকে দখলমুক্ত করতে ও নদীতে যাতে কেউ নোংরা-আবর্জনা না ফেলে তা দেখার জন্য নদী সংলগ্ন গ্রাম পঞ্চায়েতগুলোকে নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে। সেই সঙ্গে সাধারণ মানুষকেও নদী বিষয়ে সচেতন করা হবে।”
সেই সচেতনতার ফল কী হয় সে কথা অবশ্য সময় বলবে।
জলঙ্গি কথা
• ভূতাত্ত্বিক নানা কারণে পদ্মার খাত ক্রমশ গভীর হয়ে গিয়েছে।
• জলঙ্গি নদীর উৎসমুখও বন্ধ হয়ে গিয়েছে। এখন ভরসা বলতে বৃষ্টি, ভৈরব ও মাটির নীচের জল।
• নদীর বহমানতা যাতে বাধা না পায় সে দিকে সকলের নজর দেওয়া উচিত বলে মত নদী বিশেষজ্ঞদের।
• বর্ষার সময় জলঙ্গির মতো শাখানদী অতিরিক্ত জল বহন করে বন্যার হাত থেকে রক্ষা করে।
• জলঙ্গিকে দখলমুক্ত করতে চায় প্রশাসন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy