এ ভাবেই সাজানো হবে পুজোর পাত। কৃষ্ণনগরের একটি রেস্তোরাঁয় সুদীপ ভট্টাচার্যের তোলা ছবি।
মুখ দেখা যায় এমন চকচকে কাঁসার থালা উপচে পড়ছে মুচমুচে লুচি। সঙ্গে প্রমাণ সাইজের বেগুন ভাজা। থালা ঘিরে মানানসই কাঁসার বাটিতে পরপর সাজানো নারকেল কুচি-সহ ঘন ছোলার ডাল, কড়াইশুঁটি দিয়ে পনিরের তরকারি, আমের চাটনি। শেষ পাতে সিমাইয়ের পায়েস আর দুধসাদা রসগোল্লা। ধুতি পাঞ্জাবি পরা পরিবেশকরা খাওয়া শেষে এগিয়ে দিলেন পাত্রে সাজানো সুগন্ধি পান।
মহাষ্টমীর অঞ্জলি দিয়ে বেশির ভাগ বাঙালি বাড়িতে দুপুরে লুচি খাওয়াই রীতি। সেই রীতি এ বার ঘরের চৌহদ্দি ছেড়ে নামী রেস্তোরাঁর হেঁশেলেও। কৃষ্ণনগর থেকে ৩৪নং জাতীয় সড়ক ধরে সামান্য একটু এগিয়ে এক নামী রেস্তোরাঁয় তৈরি হচ্ছে অষ্টমীর স্পেশ্যাল মেনু। দামও সাধ্যের মধ্যেই। বিশেষ ওই ‘থালি’ মিলবে মাত্র ১২০ টাকায়।
আসলে রসনার সঙ্গে উপাসনার সম্পর্ক বড় নিবিড়। যে কোনও পুজোপার্বণে মহার্ঘ রেস্তোরাঁ থেকে পাড়ার মোড়ের চাউমিনের গাড়ি ঘিরে জমে ওঠা ভিড়ের বহর দেখলেই তা মালুম হয়। শুধু কি তাই! লক্ষ্মীপুজো থেকে ইতুর পালুনি কিংবা ভাইফোঁটা থেকে জামাইষষ্ঠী, বাংলার চিরকালীন পার্বণগুলির যে কোনওটির দিকে তাকালেই বোঝা যায় রকমারি সুখাদ্য ছাড়া পার্বণের কথা কোন কালেই ভাবতেই পারেনি রসনারসিক বাঙালি। ঋতুর সঙ্গে তাল মিলিয়ে মানুষ সাজিয়েছে তার ইষ্টদেবতার ভোগের থালাও।
এহেন বাঙালি যে তার শ্রেষ্ঠ উৎসবে তৃপ্তির মহাঢেকুর তোলার জন্য মরিয়া চেষ্টা করবে সেটা বলাই বাহুল্য। শুধু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে হাত বদলে গেছে হাতাখুন্তি। একান্নবর্তী পরিবারের মা-ঠাকুমারা হারিয়ে যাওয়ার পর দায়িত্বটা তুলে নিয়েছেন হোটেল রেস্তোরাঁর মালিক এবং রাঁধিয়ের দল। ভোজন রসিকরাও উপযুক্ত মূল্য দিতে পিছপা নন।
গত এক দশকে কাশফুল, ঢাকের বাদ্যি নতুন জামা, অঞ্জলির পাশে জায়গা করে নিয়েছে পুজোর খানাও। রেস্তোরাঁতে গিয়ে মোগলাই, চাইনিজ বা কন্টিনেন্টাল চেখে দেখা এখন ট্রেন্ড। আর তাঁদের জন্যই তৈরি শহর কিংবা মফস্সলের নামী অনামী রেস্তোরা।ঁ এমনকী বিয়েবাড়ি ভাড়া নিয়ে শুরু হচ্ছে বিরিয়ানি মেলা। নাগালের মধ্যে নানা কিসিমের বিরিয়ানি খেতে লম্বা লাইন লজ্জা দেবে সুপার হিট সিনেমার টিকিট কাউন্টারকে।
শুধু কি বিরিয়ানি? নবদ্বীপ স্টেশনের কাছে এক রেস্তোরাঁ এ বার কাবাবে বাজার মাত করতে চায়। চিকেন টিক্কা কাবাব, চিকেন রেশমি কাবাব, চিকেন কাবাব। সঙ্গে চিকেনের একঝাঁক পদ। ওই রেস্তোরাঁর মালিক বাপি দেবনাথ বলেন, “লোকে মুরগি বেশি পছন্দ করেন। তাই নানা রকমের চিকেন নিয়েই এ বারের পুজোর দিন গুলো কাটুক। স্টার্টার হিসেবে থাকছে তন্দুরি চিকেন। তেমনি আবার চাইনিজে গেলে চিকেন মাঞ্চুরিয়ান, চিলি চিকেন, চিকেন গারলিক থাকছে। দু’টো বিশেষ পদ এবারে আমাদের এখানে পাবেন ‘চিকেন পিপার গার্লিক’ আর ‘চিকেন স্যসে’।”
নবদ্বীপের ওই রেস্তোরাঁয় স্যুপেও থাকছে চিকেনের দাপট। সাধারণ চিকেন স্যুপের সঙ্গে পাওয়া যাবে বিশেষ চিকেন লেমনেড স্যুপও।
কৃষ্ণনগরের এক নামী রেস্তোরাঁ মালিক সঞ্জয় চাকি জানান, তাঁদের বিশেষ পদের তালিকায় আছে মটন পোলাও, বাদশাহি মটন এবং চিকেন মালাইকারী। সঞ্জয় বাবু বলেন, “এ বারে আমাদের বেশির ভাগ পদের বৈশিষ্ট হল তেলের বদলে ঘিয়ের ব্যবহার। বোনলেস মটন বাসমতী চাল দিয়ে ‘মটন পোলাও’ কিংবা বাদশাহি মটন ম্যারিনেট করা হচ্ছে ঘি দিয়ে। টম্যাটোর বদলে দেওয়া হচ্ছে আলু বখরা, শাহি জিরা ইত্যাদি। আবার চিকেন মালাইকারিতে ব্যবহার হচ্ছে জল ছাড়া চিকেন এবং নারকেলের দুধ। তবে ‘চিকেন পপকনর্র্’ আমাদের এবারের অন্যতম বিশেষ পদ। বোনলেস চিকেন চার ঘণ্টা ধরে ম্যারিনেট করে তারপর স্টিম করে কর্নফ্লেক্স দিয়ে ফ্রাই।”
তবে এ সব পদের নাম যেমন গালভরা, দাম কিন্তু ততটা আহামরি নয়। মটন পোলাও ১৫০ টাকা, বাদশাহি মটন ১৭০ টাকা, চিকেন মালাইকারি ১৩০ টাকা, চিকেন পপকর্ন ১৩০ টাকা বা চিকেন টিকিয়া ১৩০ টাকা। এই বিষয়ে সঞ্জয় চাকি সাফ বলেন, “এখন কিন্তু রেস্তোরাঁতে শুধুমাত্র খুব পয়সাওয়ালা মানুষেরা খেতে আসেন এমন নয়। সব ধরনের মানুষই এখন রেস্তোরাঁমুখী হচ্ছেন। তাই সকলের রুচি ও সামর্থ্য ভেবেই আমরা পদের দাম ঠিক করি।”
সে কথা ভেবেই অষ্টমীর দিন লুচি ছোলার ডালের থালির ভাবনা। অনান্য দিনে আবার অন্য রকম পদ। দশমীর দিনে যাঁরাই খেতে আসবেন তাঁদের জন্য নারকেল নাড়ু উপহার দেবেন রেস্তোরাঁ কর্তৃপক্ষ।
তবে মিষ্টি ছাড়া উৎসব বাঙালি ভাবতেই পারে না। সুতরাং সাজ সাজ রব সেখানেও। রসগোল্লা, পান্তুয়া সন্দেশ, অধরের সরপুরিয়া, নবদ্বীপের দই, শান্তিপুরের নিখুতি এসব তো আছেই। তা বলে কি নতুন মিষ্টি তৈরি থেমে থাকবে?
খাস্তা রসগোল্লার সব রস চিপে ফেলে তাকে ডুবিয়ে রাখা হবে ‘নালি ক্ষীরে’। রসগোল্লা ক্ষীরে ভর্তি হয়ে উঠলে তাকে সুগন্ধি কেশর মাখিয়ে পরিবেশন করা হবে। নাম কেশরিভোগ, দাম ১০ টাকা প্রতিটি। কৃষ্ণনগরের চার পুরুষের মিষ্টান্ন ব্যবসায়ী তাপস দাসের দাবি, এ বারের পুজোয় কেশরিভোগ ‘হটকেক’। আনন্দময়ী তলায় শতবর্ষের এই প্রতিষ্ঠান শুরু থেকেই নদিয়া রাজবাড়ির পুজোর বিশেষ মিষ্টি, চিনির সন্দেশ, পক্কান, দোলো চিনি, দরবেশ তৈরি করে আসছে। বর্তমান মালিক তাপস দাস বলেন, “আমরা সব সময় কিছু নতুন ধরনের মিষ্টি তৈরি করি। তার মধ্যে কেশরিভোগ অন্যতম। এছাড়াও ক্ষীর, কাজু, কিসমিস, জায়ফল, জয়িত্রী মেশানো পাতলা রসে জ্বাল দেওয়া দরবেশের খুব চাহিদা। দাম প্রতিটি ৫ টাকা। শান্তিপুরের নিখুতির থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক ধরনের নিখুতি হয়। যেখানে ছানাকে চুষির পাপড়ের মতো লম্বা করে ঘিয়ে ভেজে একটু গাঢ় রসে ডুবিয়ে রাখা হয়। তারপর রস ঝরিয়ে শেষে ক্ষীর, এলাচ মেশানো হয়। দাম প্রতিটি ৬ টাকা। বিজয়ার পর নিখুতি, প্রাণহরা বা পাতা চমচমের খুব চাহিদা থাকে।” সে চাহিদা সামাল দেওয়ার প্রস্তুতি পর্ব সারা। এখন অপেক্ষা শুধু বোধনের।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy