ইন্দ্রনীলের পারলৌকিক কাজ সেরে বাড়ির পথে বাবা, মা-সহ পরিজনেরা।ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য
‘মা, পুলিশে কেস করেছ? পুলিশকে সব জানিয়েছ তো?’
মৃত্যুর কিছুক্ষণ আগে মা ইলোরাদেবীকে এমনটাই বলেছিলেন ইন্দ্রনীল রায়। বুধবার রাতে দাদুর বাৎসরিক কাজে যোগ দিতে যাওয়ার পথে কৃষ্ণনগর স্টেশন লাগোয়া এলাকায় দুষ্কৃতীদের দুই গোষ্ঠীর গোলমালের জেরে ছোড়া গুলিতে খুন হন কৃষ্ণগঞ্জের ওই ছাত্র। মারা যাওয়ার আগের মুহূর্তেও পুলিশের উপরে আস্থা রেখেছিলেন তিনি। অথচ ঘটনার পর পাঁচ দিন কেটে গেলেও পুলিশ একজনকেই ধরতে পেরেছে। অভিযুক্ত মূল দুষ্কৃতী এখনও পলাতক। জেলার পুলিশ সুপার অর্ণব ঘোষ অবশ্য বলছেন, “তদন্ত আমরা অনেকটাই গুটিয়ে এনেছি। স্পেশ্যাল অপারেশন টিম এই তদন্তের দায়িত্ব নিয়েছে। আশা করছি বাকিদেরও খুব শীঘ্র আমরা গ্রেফতার করতে পারব।”
পুলিশের ভূমিকায় সন্তুষ্ট নয় ইন্দ্রনীলের পরিবারের লোকজন। ওই ছাত্রের বাবা গৌতমবাবু বলছেন, “শুনছি পুলিশ নাকি একজনকে গ্রেফতার করেছে। অন্যান্য ঘটনার থেকে আমার ছেলের বিষয়ে নাকি পুলিশ অনেক বেশি সক্রিয়। কিন্তু এখনও পর্যন্ত মূল আসামীদের কাউকেই তো পুলিশ গ্রেফতার করতে পারেনি।” ছেলের নানা স্মৃতি নিয়ে নাগাড়ে কেঁদে চলেছেন মা ইলোরাদেবী। তিনি বলেন, “শেষের দিকে ইন্দ্রনীলের প্রচন্ড শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল। ও মনে হয় আগেই বুঝতে পেরেছিল যে ও চলে যাবে। মৃত্যুর আগে আমারই কোলে মাথা রেখে আমাকে বারবার জিজ্ঞাসা করছিল যে, পুলিশকে আমি সব জানিয়েছি কি না।” মূল দুষ্কৃতীরা এখনও অধরা শুনে তিনি বলেন, “মৃত্যুর আগের মুহূর্ত পর্যন্ত ছেলে পুলিশের উপরেই ভরসা রেখেছিল। ফলে আমাদেরও তাই করতে হচ্ছে। এছাড়া তো আর কোনও উপায় নেই।”
রবিবার ইন্দ্রনীলের পারলৌকিক কাজ উপলক্ষে বাড়িতে ছিল আত্মীয়দের ভিড়। মাঝেমধ্যেই কান্নার রোল উঠছিল। বাড়ির এক কোনে ইন্দ্রনীলের ছোট্ট একটা পড়ার ঘর। দেওয়ালে টাঙানো বিবেকানন্দের ছবি। টেবিলের উপরে পড়ার বইয়ের সঙ্গে সযত্নে রাখা বিবেকানন্দের বই। আর তার পাশে রাখা চে গুয়েভারার ছবি। গৌতমবাবু বলেন, “বিবেকানন্দ ও চে-র ভক্ত ছিল ইন্দ্রনীল। ভালোবাসত বই পড়তে ও ছবি আঁকতে।” অত্যন্ত ভদ্র ও শান্ত স্বভাবের ইন্দ্রনীলের খুন হওয়ার ঘটনা কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না কৃষ্ণগঞ্জের মানুষ। এই ঘটনায় শাসক দলের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন তাঁরা। বছরখানেক আগে এই কৃষ্ণগঞ্জেই খুন হয়েছিল কৃষ্ণগঞ্জ অনিল স্মৃতি হাই স্কুলের একাদশ শ্রেণির ছাত্র তন্ময় সিংহ। সেই ঘটনায় ছুটে এসেছিলেন তৃণমূল ছাত্র পরিষদের রাজ্য সভাপতি শঙ্কুদেব পণ্ডা। জেলার নেতা-মন্ত্রীদের সঙ্গে ছুটে এসেছিলেন পার্থ চট্টোপাধ্যায়ও। ঘটনার পরের দিনই পুলিশ অভিযুক্তকে গ্রেফতারও করেছিল। কিন্তু ইন্দ্রনীলের ক্ষেত্রে শাসক দলের কেউই এখনও পর্যন্ত তাঁর বাড়িতে গিয়ে সমবেদনাটুকুও জানাননি। শাসক দলের এমন ভূমিকা দেখে এলাকার বাসিন্দাদের একাংশের প্রশ্ন, “এই খুনের ঘটনায় শাসক দলের ছত্রছায়ায় থাকা দুষ্কৃতীর নাম উঠে আসার কারণেই কি এই উদাসীনতা?”
শনিবারই কৃষ্ণনগরে বামফ্রন্টের সমাবেশে বক্তব্য রাখতে গিয়ে রাজ্যের বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র অভিযোগ করেছিলেন, “তৃণমূল নিজেরাই নিজেদের আক্রমণ করছে। তার মাঝখানে পড়ে একটি নিরীহ ছাত্র মারা গেল।” মূল আসামী নিতাইকে আবার একদা সিপিএম ঘনিষ্ঠ বলে পাল্টা দাবি করেছেন তৃণমূলের জেলা সভাপতি গৌরীশঙ্কর দত্ত। শুক্রবার অবশ্য নিহত ছাত্রের পরিবারের সদস্যরা পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছিলেন যে, তাঁরা এই মৃত্যুকে ঘিরে কোনওরকম রাজনৈতিক কচকচানি চান না। তাঁরা শুধু ছেলের খুনিদের চরম সাজা চান। এ দিনও নিহত ওই ছাত্রের কাকা উত্তমবাবু বলেন, “আমার ভাইপোর খুনের ঘটনায় যাঁরা সমব্যথী, তাঁরা সকলেই আসুন। কিন্ত দয়া করে কেউ যেন রাজনীতি না করেন।” রবিবার নিহত ছাত্রের পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে যান বিজেপি-র একটি প্রতিনিধি দল। জেলা মুখপাত্র সৈকত সরকার বলেন, “রাজনীতি করতে আসিনি। আমরা এসেছি পরিবারটির পাশে থাকতে।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy