Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

মেয়ের ভাল ফলেও চিন্তায় পরিবার

সহপাঠীরা তার থেকে ঢের কম নম্বর পেয়েছে। তার পরেও সেই সহপাঠীদের বাড়িতে খুশির হাওয়া বইছে। অথচ স্কুলের পুরনো রের্কড ভাঙা মেয়ের সাফল্যে আঁধার ঘনিয়েছে পরিবারে। সবাইকে তাক লাগিয়ে আমোদপুর জয়দুর্গা বালিকা বিদ্যালয় থেকে এ বার উচ্চ মাধ্যমিকে কলা বিভাগে ৪৫০ নম্বর পেয়েছে অনুরূপা নাগ!

অনুরূপা নাগ। —নিজস্ব চিত্র।

অনুরূপা নাগ। —নিজস্ব চিত্র।

অর্ঘ্য ঘোষ
আমোদপুর শেষ আপডেট: ০৩ জুন ২০১৫ ০০:৫৫
Share: Save:

সহপাঠীরা তার থেকে ঢের কম নম্বর পেয়েছে। তার পরেও সেই সহপাঠীদের বাড়িতে খুশির হাওয়া বইছে। অথচ স্কুলের পুরনো রের্কড ভাঙা মেয়ের সাফল্যে আঁধার ঘনিয়েছে পরিবারে। সবাইকে তাক লাগিয়ে আমোদপুর জয়দুর্গা বালিকা বিদ্যালয় থেকে এ বার উচ্চ মাধ্যমিকে কলা বিভাগে ৪৫০ নম্বর পেয়েছে অনুরূপা নাগ!
আর তার পরেই দুশ্চিন্তার মেঘ ভিড় করেছে আমোদপুর সুগার মিলের প্রাক্তন কর্মী অশোককুমার নাগের জীবনে। কারণ, নুন আনতে পান্তা ফুরানোর হাল সংসারে। এত দিন পরের অনুগ্রহে কোনও রকমে মেয়ে অনুরূপাকে পড়িয়েছেন। কিন্তু, এর পর কী হবে, ভেবে কুল পাচ্ছেন না তিনি। পড়াশোনা করে বড় হওয়ার স্বপ্ন মেয়ের দু’চোখে। অথচ আর্থিক সঙ্গতির অভাবে কী করে তা বাস্তবায়িত হবে, ভেবেই চোখের ঘুম হারিয়ে গিয়েছে গোটা পরিবারের। হাতের কাছে যাঁকেই পাচ্ছেন, মেয়ের উচ্চ শিক্ষার জন্য সাহায্য প্রার্থনা করছেন। প্রতিশ্রুতি মিললেও এখনও পর্যন্ত কেউ বাড়িয়ে দেননি সহযোগিতার হাত। তাই মেয়ের ভাল ফল করার জন্য যে বাড়িতে খুশির হাওয়া বইবার কথা, সেখানেই এখন দুশ্চিন্তার কালো মেঘ।

আমোদপুর সংলগ্ন কুচুইঘাটায় ছোট্ট সংসার অশোকবাবুর। এক সময় স্থানীয় সুগার মিলে সামান্য বেতনের কর্মী ছিলেন তিনি। মিল বন্ধ হওয়ার সময় বাধ্যতামূলক আগাম অবসর নেওয়ার বিনিময়ে হাতে যা টাকা পেয়েছিলেন, তা খরচ হয়ে গিয়েছে বড় মেয়ের বিয়ে দিতেই। এখন স্ত্রী রেখাদেবী এবং ছোট মেয়ে অনুরূপাকে নিয়ে তাঁর তিন সদস্যের সংসার চলে মাসিক এক হাজার টাকা পেনশন এবং যৎসামান্য জমির আয়ে।

অনুরূপার স্কুল সূত্রে জানা গিয়েছে, এর আগে ওই স্কুলে এত নম্বর আর কেউ পায়নি। স্বভাবতই অনুরূপাকে ঘিরে খুশির অন্ত নেই স্কুলে। কিন্তু, অনুরূপা নিজে সেই খুশিতে শরিক হতে পারছে না। কী করে পড়াশোনা চালিয়ে যাবে, সেই দুশ্চিন্তাই বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। অথচ বিশ্বভারতীতে ইংরেজি নিয়ে পড়াশোনা করে ভবিষ্যতে ডব্লিউবিসিএস অফিসার হতে চাই সে। কিন্তু, কী করে কী হবে, তা জানা নেই মেয়ের। রবিবার সে বলে, ‘‘এত দিন স্কুলের দিদিমণি, শুভানুধ্যায়ীদের সাহায্যে বাড়িতে থেকে পড়াশোনা করতে পেরেছি। তা-ও আমার পড়ার জন্য বাবাকে অনেকের কাছে সাহায্য চেয়ে ছোট হতে হয়েছে। মেয়ে হয়ে বাবাকে আর ছোট করতে মন চাইছে না। কোনও উপায় হলে ভাল। না অন্য কিছু ভাবতে হবে।’’

মেয়ের এই দোটানায় আরও মনমরা হয়ে পড়েছেন বাবা-মা। তাঁরা বলছেন, ‘‘আমাদের অভাবের সংসার ঠিকই। কিন্তু, আমরাও তো বাবা-মা। যখন মেয়ের চেয়ে কম নম্বর পাওয়া ছেলেমেয়ের বাবা-মা’কে খুশিতে আড়ম্বরে উদযাপন করতে দেখি তখন অক্ষমতায় আমাদের চোখ ফেটে জল আসে। শুধু ভাবি, কী করে মেয়ের স্বপ্ন পূরণ করব।’’

নবম শ্রেণি থেকে বিনা পারিশ্রমিকে অনুরূপাকে বাংলা পড়িয়েছেন স্কুলেরই শিক্ষিকা মধুশ্রী দে। ইংরেজি পড়িয়েছেন লাগোয়া জয়দুর্গা হাইস্কুলের শিক্ষক প্রসেনজিৎ মুখোপাধ্যায়। দু’জনের বলেন, ‘‘প্রয়োজনীয় সুযোগ এবং সুবিধা পেলে অনুরূপা আরও ভাল ফল করতে পারত। ওই রকম একটি দুঃস্থ পরিবার থেকে এই ফল করাটা সহজ ব্যাপার নয়। ঠিক মতো সুযোগ পেলে ও অনেক দূর যাবে।’’ একই অভিমত স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা চন্দনা সাহা সর্দারেরও (‌চৌধুরী)। তিনি বলেন, ‘‘এর আগে উচ্চ মাধ্যমিকে স্কুলে অনুরূপার মতো কেউ নম্বর পায়নি। প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে ও স্কুলের মুখ উজ্জ্বল করেছে।’’ অনুরূপাকে স্কুল থেকে সাহায্য করার আশ্বাস তিনি দিয়েছেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE