Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪

রুবিদের দুঃখ ঘুচিয়েছে যৌথ রান্নাঘর

বৃষ্টি হলেই উনুন নিভে যেত। মাঝপথে বন্ধ হয়ে যেত রান্না। খড়ের চালের ফুটো বেয়ে নোংরা জলে ভরে যেত হাঁড়ি কড়াই। বৃষ্টি-বাদলের দিনগুলিতে রান্না সারতে কার্যত চোখের জল আর নাকের জল এক হয়ে যেত সুন্দরী কিস্কুদের। কোনও রকমে আসলে মাথা গোঁজার ঠাঁই থাকলেও অধিকাংশেরই নেই রান্নার জায়গা।

সামাজিক রান্নাশালে রান্না করছেন গ্রামের বধূরা। ছবি: সোমনাথ মুস্তাফি।

সামাজিক রান্নাশালে রান্না করছেন গ্রামের বধূরা। ছবি: সোমনাথ মুস্তাফি।

অর্ঘ্য ঘোষ
ময়ূরেশ্বর শেষ আপডেট: ৩০ জুলাই ২০১৫ ০১:২২
Share: Save:

বৃষ্টি হলেই উনুন নিভে যেত। মাঝপথে বন্ধ হয়ে যেত রান্না। খড়ের চালের ফুটো বেয়ে নোংরা জলে ভরে যেত হাঁড়ি কড়াই।

বৃষ্টি-বাদলের দিনগুলিতে রান্না সারতে কার্যত চোখের জল আর নাকের জল এক হয়ে যেত সুন্দরী কিস্কুদের। কোনও রকমে আসলে মাথা গোঁজার ঠাঁই থাকলেও অধিকাংশেরই নেই রান্নার জায়গা। খোলা আকাশের নীচে কিংবা শুয়োর-ছাগলের খোঁয়াড়ের এক কোণে রান্নার কাজ সারতে হত ময়ূরেশ্বরের মেটেলডাঙ্গার সুন্দরী কিস্কু, রুবি মাড্ডিদের। তাঁদের দীর্ঘদিনের সেই দুর্দশা ঘুচিয়ে দিয়েছে গ্রামেরই যৌথ রান্নাঘর। যার পোশাকি নাম সামাজিক রন্ধনশালা।

বছর চারেক সেই দুর্দিনের কথা মনে পড়লে এখনও দু’চোখের কোণ জলে ভরে যায়। মনে পড়ে, এমনও দিন গিয়েছে, রান্না হয়নি বলে ছেলেমেয়েদের মুখে দু’মুঠো ভাত তুলে দিতে পারেননি তাঁরা। শুকনো মুড়ি চিবিয়ে আস্ত রাত কেটেছে এই এলাকার অধিকাংশ আদিবাসী পরিবারের। ২৪টি হতদরিদ্র আদিবাসী পরিবারের বাস মেটেলডাঙ্গায়। অধিকাংশের খড়ের চালের মাটির বাড়ি। ওই সব বাড়িতে আলাদা করে কোনও রান্নাঘর নেই। সেই কারণেই খোলা আকাশের নীচে কিংবা গবাদি পশুর গোয়ালের এককোণে রান্না করেন তাঁরা। বৃষ্টি হলেই একদিকে গোয়ালের চাল ফুটে জল পড়ে অন্যদিকে মাঠভাসি জল পৌঁছে যায় বাড়ির দোরগোড়ায়। সে দিন রান্না খাওয়া মাথায় ওঠে। ২০১১ সালে আদিবাসী পরিবারগুলির এহেন সমস্যার কথা শুনে এগিয়ে আসেন তৎকালীন সংশ্লিষ্ট ময়ূরেশ্বর ১ নং ব্লকের বিডিও মনোমোহন ভট্টাচার্য। তিনিই মল্লারপুরের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাকে সামিল করে ওই গ্রামে তৈরি করান যৌথ রান্নাঘর বা সামাজিক রন্ধনশালা।

কেমন সেই রান্নাশালা?

একটি বড়ো আকারের রান্না ঘরে সার সার গ্যাসের উনুন। সাজানো কিছু রান্নার সরঞ্জামও। এখন বৃষ্টি বাদলার দিনে নিজেদের বাড়িতে রান্না করা সম্ভব না হলে আদিবাসী বধূরা হাঁড়ি-কড়াই এবং চাল, ডাল নিয়ে হাজির হয়ে যান যৌথ রান্নাঘরে। তারপর গ্যাস জ্বালিয়ে রান্না করে নিয়ে বাড়ি যেতে পারেন। প্রয়োজনে রান্নাঘর লাগোয়া পাকা রোয়াকে সকলে মিলে খাওয়া দাওয়াও করতে পারেন। মাসের শেষে ব্যবহারকারীদের নিজেদের মধ্যে চাঁদা করে গ্যাসটুকু ভরে নিতে হয় মাত্র। তাতে অবশ্য একটুও পিছপা নন পাকু হাঁসদা, দুলো টুডুরা। তাঁরা জানান, ‘‘আমরা জঙ্গল থেকে জ্বালানি সংগ্রহ করেই রান্না করি। গ্যাসের জন্য কিছুটা উদ্বৃত্ত খরচ হয় ঠিকই, কিন্তু এখন আর আমাদের অভুক্ত থাকতে হয় না। বৃষ্টিতে খাবার নষ্টও হয় না। সেখান থেকেই পুষিয়ে যায় গ্যাসের খরচ।’’

ওই প্রকল্প রূপায়নকারী স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কর্ণধার সাধন সিংহ বলেন, ‘‘মনমোহনবাবুর প্রচেষ্টায় একটি রাষ্টায়ত্ত ব্যাঙ্ক, নেহেরু যুবকেন্দ্র এবং ন্যাশান্যাল স্যাম্পেল সার্ভে এমপ্লয়িজ ফেডারেশন সোসাইটি লিমিটেডের অর্থানুকুল্যে প্রায় ১ লক্ষ ২০ হাজার টাকা খরচ করে ওই রান্নাঘর তৈরি হয়। ইন্ডিয়ান ওয়েল ৪টি সিলিন্ডার সহ ৫টি ওভেন দেয়। সীমিত ওই টাকার প্রকল্প যে হতদরিদ্র পরিবারগুলির এত উপকারে আসবে সেদিন ভাবতেও পারিনি।’’

গ্রামের ২৪ ঘরের ‘এক চাতাল’ ও ওই আদিবাসী বধূদের আরও এক দুর্দশা ঘুচিয়েছে। গ্রামের কয়েকটি পরিবারের যৎসামান্য জমি রয়েছে। বর্গা কিংবা ভাগ চাষ করেও ধান-গম সহ কিছু খাদ্যশস্য ঘরে আসে কিছু পরিবারের। কিন্তু কোনও পরিবারেই সেইসব খাদ্যশস্য শুকানোর মতো কোনও জায়গা নেই। সম্প্রতি গ্রামের ভিতর কিছুটা ঢালাই রাস্তা তৈরি হলেও এতদিন প্রায় আধ কিমি দূরের পীচ রাস্তায় বস্তা ভর্তি সিদ্ধ ধান শুকানোর জন্য যেতে হত আদিবাসী বধূদের। তারপর রাস্তায় ধান মেলে দিয়ে দিনভর ঠায় পাহারায় থাকতে হত। ২০১২ সাল থেকে তাঁদের সেই দুর্ভোগ ঘুচেছে।

ওই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কিনে দেওয়া জমিতে জেলা গ্রামোন্নয়ন দফতরের অর্থানুকুল্যে প্রায় আধকাঠা জায়গা জুড়ে তৈরি হয়েছে ধান, গম শুকানোর জন্য কংক্রিটের যৌথ চাতাল। চাতালের একদিক তৈরি হয়েছে একটি ছোট্ট ঘরও। এখন সেখানে একসঙ্গে ৬/৭টি পরিবার ধান-গম শুকাতে পারেন। হঠাৎ বৃষ্টি নামলে কিংবা বাড়ি নিয়ে যাওয়ার সমস্যা হলে ওই ঘরেই রেখে দিতে পারেন ধান-গম।

দুলো টুডু, চুড়কি মুর্মরা বলেন, ‘‘এখন আর আমাদের দূরের রাস্তায় ধান শুকাতে গিয়ে দিনভর কামাই করে বসে থাকতে হয় না। এক চাতালে একসঙ্গে ধান মেলে দিয়ে পালাক্রমে নাড়া-চাড়া করলেই চলে।’’ সাধনবাবুর মতে, শুধু বাসিন্দাদের সুবিধাই নয়, গ্রামে গ্রামে ওই যৌথ চাতালের ব্যবস্থা করা হলে রাস্তার উপদ্রব অনেকখানিই কমতে পারে।

জেলা পরিষদের সভাধিপতি বিকাশ রায় চৌধুরী বলেন, ‘‘ওই দুই প্রকল্পের গ্রহণযোগ্যতা খতিয়ে দেখার পর যদি সত্যিই বাস্তব সম্মত মনে হয় তাহলে আর্থিক সংস্থান অনুযায়ী ধাপে ধাপে রূপায়ণের চেষ্টা করা হবে এলাকা জুড়ে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE