বিচার: আদালতে সাজাপ্রাপ্তেরা। —নিজস্ব চিত্র।
প্রক্রিয়া শেষ হতেই পার হয়ে গিয়েছে দু’টি যুগ। বিচার অবশেষে পেল নিহত তিন ব্যক্তির পরিবার। ২৪ বছর আগে ওই তিন খুনের ঘটনায় অভিযুক্ত ২৩ জনকেই যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সাজা শোনাল বাঁকুড়া আদালত। শেষ কবে এত জন অভিযুক্তের এক সঙ্গে যাবজ্জীবন হয়েছে, তা মনে করতে পারছেন না বাঁকুড়া জেলা আদালতের প্রবীণ আইনজীবীরাও।
বুধবার বাঁকুড়ার অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা বিচারক (১) মাশুক হোসেন খানের এজলাসে যখন এই রায় দান হচ্ছে, তখন এজলাসের বাইরে কয়েকশো উৎসাহী মানুষের জটলা। শেষ পর্যন্ত সকলেরই যাবজ্জীবন কারাবাসের সাজা ঘোষণা হওয়ায় নিহতদের পরিবার ও তাঁদের প্রতিবেশীদের মুখে হাসি ফোটে। তবে, এই ঘটনাকে ঘিরে রাজনৈতিক তরজা শুরু হয়েছে বিজেপি এবং সিপিএমের মধ্যে। বিজেপি-র দাবি, নিহতেরা তাদের সমর্থক ছিলেন বলেই সিপিএমের লোকজন আক্রোশবশত ওই খুনের ঘটনা ঘটিয়েছিল। সিপিএম অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছে।
দিনটা ছিল ১৯৯৩ সালের ১২ মার্চ। বাঁকুড়া শহর সংলগ্ন রায়বাঁধের গ্যাজাড়েবাড়ি এলাকায়। সরকার পক্ষের আইনজীবী অরুণ চট্টোপাধ্যায় জানিয়েছেন, ওই দিন সকালে রায়বাঁধের বাসিন্দা অনিল রানা তাঁর তিন ভাই রঞ্জিত, অর্জুন ও অসিতকে নিয়ে জমিতে সেচের জল দিতে গিয়েছিলেন। আচমকাই তাঁদের ঘিরে ধরে জনা চল্লিশেক স্থানীয় লোক। তাদের হাতে টাঙি, বল্লম, রড, লাঠির মতো অস্ত্রসস্ত্র ছিল। চার ভাইকে ঘিরে ধরে এলোপাথাড়ি মারধর করতে থাকে তারা। সেই সময় আশপাশের জমিতে গ্রামের অনেক বাসিন্দাই চাষের কাজ করছিলেন। সকলেই হামলাকারীদের হাত থেকে ওই চার ভাইকে বাঁচাতে ছুটে এলে মারধরের মুখে পড়েন তাঁরাও।
আদালতের বাইরে উৎসাহী মানুষজনের ভি়ড়। বুধবার। —নিজস্ব চিত্র।
পুলিশ সূত্রের খবর, এই ঘটনায় মৃত্যু হয় অনিল রানা (৩৮), তাঁর ভাই রঞ্জিত (৩৬) এবং পড়শি প্রমথ রানার (৫২)। মারের চোটে ঘটনাস্থলেই মারা যান রঞ্জিতবাবু ও প্রমথবাবু। অনিলবাবু পরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। গুরুতর জখম হন আট জন গ্রামবাসী। হতাহতেরা সকলেই রায়বাঁধের বাসিন্দা। হামলা চালানোর পরে দুষ্কৃতীরা চলে গেলে স্থানীয় বিজেপি নেতা মহাদেব রানা গ্রামবাসীদের সাহায্যে জখমদের হাসপাতালে নিয়ে যান। তৎকালীন বাঁকুড়া সদর থানার ওসি নির্মলেন্দু তালুকদার এই ঘটনার তদন্তকারী আধিকারিক ছিলেন। মহাদেববাবুই ওই ঘটনায় ৩৭ জন এলাকাবাসীর বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ দায়ের করেছিলেন। অভিযুক্তেরা সকলেই এলাকায় সিপিএম কর্মী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। এ দিন রায়দানের পরে মহাদেববাবু দাবি করেন, হতাহতদের মধ্যে অনেকেই সে সময় বিজেপি-র সমর্থক ছিলেন। সেটা মেনে নিতে পারেনি সিপিএম। হামলার পিছনে রায়বাঁধ গ্রামের বাসিন্দা, এক সিপিএম নেতার ইন্ধন ছিল বলেও তাঁর অভিযোগ।
তদন্তে নেমে ঘটনার দেড় বছর পরে, ১৯৯৪ সালের ৩০ নভেম্বর আদালতে চার্জশিট জমা করে পুলিশ। সরকারি আইনজীবী জানান, অভিযুক্তেরা সকলেই জামিনে মুক্ত ছিলেন। মামলা চলাকালীন অভিযুক্তদের মধ্যে চার জনের মৃত্যু হয়। বাকিদের মধ্যে চার জন মহিলা উপযুক্ত সাক্ষ্য প্রমাণের অভাবে ছাড়া পেয়েছেন। ঘটনার সময় আরও ছয় অভিযুক্ত নাবালক হওয়ায় তাদের বিচার আলাদা ভাবে হচ্ছে। বাকি ২৩ জন অভিযুক্তকেই আদালত যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও ১০ হাজার টাকা করে জরিমানার নির্দেশ দিয়েছে।
এজলাসে সাজা শোনার সময় অভিযুক্তদের অনেকেই কান্নায় ভেঙে পড়েন। নিহতদের পরিবারের অনেক সদস্যের চোখেও ছিল জল। তবে, ন্যায় পাওয়ার স্বস্তিতে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy