Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪
পাঁচ কিশোরের ঠাঁই হোমে

বন্ধুর বাড়ি দেখতে পঞ্জাব থেকে লুকিয়ে পাড়ি ওন্দায়

গাছগাছালি ঘেরা একটা সবুজ গ্রাম। নাম গোয়ালতোড়। সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে মাটির বাড়ি, নিকানো দাওয়া। বন্ধুর মুখে গল্প শুনে সেই নতুন দেশ ওদের হাতছানি দিয়ে ডাকত। বাড়িতে বললে যে যাওয়ার অনুমতি মিলবে না, সেই ব্যাপারে এক প্রকার নিশ্চিত ছিল পঞ্জাবের পাতিয়ালার চার কিশোর— প্রেম, সুরজিৎ, যশবিন্দর এবং ধর্মেন্দ্র।

উদ্ধারের পরে।—নিজস্ব চিত্র

উদ্ধারের পরে।—নিজস্ব চিত্র

নিজস্ব সংবাদদাতা
ওন্দা শেষ আপডেট: ২৪ অক্টোবর ২০১৬ ০১:৩১
Share: Save:

গাছগাছালি ঘেরা একটা সবুজ গ্রাম। নাম গোয়ালতোড়। সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে মাটির বাড়ি, নিকানো দাওয়া। বন্ধুর মুখে গল্প শুনে সেই নতুন দেশ ওদের হাতছানি দিয়ে ডাকত। বাড়িতে বললে যে যাওয়ার অনুমতি মিলবে না, সেই ব্যাপারে এক প্রকার নিশ্চিত ছিল পঞ্জাবের পাতিয়ালার চার কিশোর— প্রেম, সুরজিৎ, যশবিন্দর এবং ধর্মেন্দ্র। বন্ধু রাহুল যখন বাড়ি ফিরছে, কাউকে কিছু না জানিয়ে তার সঙ্গে ট্রেনে চেপে বসে ওরাও। এ দিকে বাড়িতে তোলপাড়। থানায় নিখোঁজের ডায়েরি করা হয়। অবশেষে, রবিবার ওন্দার নাকাইজুড়ি এলাকা থেকে চার মূর্তিমানকে উদ্ধার করেছে পুলিশ।

গোয়ালতোড়ের একটি দুঃস্থ পরিবারের কিশোর রাহুল পাণ্ডে। বেশ কয়েক বছর ধরে পাতিয়ালার প্রতাপনগর এলাকায় মাসির বাড়িতে থাকে সে। পুলিশ জানিয়েছে, সেই সূত্রেই রাহুলের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয় ভারত নগরের ধর্মেন্দ্র ঠাকুর, কৃষ্ণ কলোনির প্রেম চাঁদ, নব্যা রোডের যশবিন্দর কুমার এবং কৃষ্ণ কলোনির সুরজিৎ কুমারের। পাঁচ বন্ধুরই বয়স দশ থেকে পনেরো বছরের মধ্যে। তবে বাড়িতে অভাবের জেরে স্কুলের পাট চোকাতে হয়েছে। দিন ছয়েক আগে পাতিয়ালা থানায় চার কিশোরের পরিবার নিখোঁজ ডায়েরি দায়ের করে। পুলিশ ‘মিসিং চাইল্ড ট্র্যাকিং পোর্টাল’-এ যাবতীয় তথ্য আপলোড করে। তার সঙ্গে যোগ রয়েছে সারা দেশের সমস্ত থানার। ওন্দা থানার পুলিশও খবরটা জানতে পারে।

রবিবার ভোরে পাঁচ কিশোর নাকাইজুড়ি মোড়ের একটি চায়ের দোকানে বসে খোশগল্প করছিল। কিন্তু ভাষাটা বাংলা নয়। এলাকার সিভিক ভল্যান্টিয়ারদের ব্যাপারটা দেখে বেশ সন্দেহজনক লাগে। তাঁরা খবর দেন ওন্দা থানার ওসি প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়কে। পুলিশ এসে সবাইকে নিয়ে থানায় যায়। কথা বলতেই গল্পটা খোলসা হয়। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের পরে পুলিশ জানতে পেরেছে, পাতিয়ালা থেকে প্রথমে দিল্লি গিয়েছিল পাঁচ জন। রাহুলের বাড়ি ফেরার টিকিট কেটে দিয়েছিলেন তার মাসিই। অন্য চার জনও টিকিট কেটে এক সঙ্গে চেপে পড়ে নিউদিল্লি-পুরী নীলাচল এক্সপ্রেসে। বৃহস্পতিবার রাতে এসে সবাই নামে বিষ্ণুপুরে। সেখান থেকে সটান গোয়ালতোড়।

এ দিকে, রাহুলের মা সীতাদেবী পুলিশকে জানিয়েছেন, এর আগেও ছেলে একা মাসির বাড়ি থেকে ফিরেছে। এ বারও তাঁর বোন ফোন করে রাহুলের ফেরার খবর জানিয়ে রেখেছিলেন।

তিনি বলেন, ‘‘ছেলের সঙ্গেও যে বন্ধুরাও থাকছে সেটা ঘুণাক্ষরেও জানতাম না। একসঙ্গে পাঁচ জনকে দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। তবে তখন কি আর জানতাম এই কাণ্ড! ভেবেছি সবাই নিশ্চই বাড়িতেই বলে এসেছে।’’ গোয়ালতোড়ে এসে বেশ মজাতেই ছিল পাঁচ বন্ধু। তবে সেটা বেশি দিন সইল না।

ছেলে আর তার বন্ধুদের কাণ্ডকারখানা পুলিশের মুখে শুনে সীতাদেবীর প্রায় আকাশ থেকে পড়ার জোগাড়। এমনকী পাঁচ কিশোরকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে গিয়ে তাজ্জব বনে গিয়েছেন খোদ ওসি প্রসেনজিৎবাবুও। তারা জানিয়েছে, গোয়ালতোড়ে আসার পরিকল্পনা আগে থেকেই করে রেখেছিল। কিন্তু পাছে বাড়ির কেউ সন্দেহ করে, তাই এক কাপড়়ে বেরিয়ে এসেছে। এত দূরের জায়গা, অজানা রাস্তা— ভয় করেনি? প্রেম, সুরজিৎ, ধর্মেন্দ্র এবং যশবিন্দর তৎক্ষণাৎ বলেছে, ‘‘ভয় কীসের? আমরা রাস্তা না জানলেও ট্রেন তো জানে!’’ এমন উত্তর শুনে তো জাঁদরেল পুলিশকর্মীরাও থ।

রবিবারই বাঁকুড়ার শিশু কল্যাণ সমিতির সদস্য অপূর্ব মণ্ডলের বেঞ্চে পাঁচ জনকে হাজির করা হয়। চারজনের কেউ কাউকে ছেড়ে থাকতে চায়নি। সবাইকে রাখা হয় হোমে। শিশু কল্যাণ সমিতি সবাইকে বাড়ি পোঁছে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে। সেই মত ওন্দার পুলিশ যোগাযোগ করেছে পাতিয়ালা থানা মারফৎ খবর দিয়েছে চার জনের বাড়িতে।

জেলা পুলিশ সুপার সুখেন্দু হীরা বলেন, “যা শুনেছি, তাতে মনে হয়েছে ছেলেগুলোর ভয়-ডরের কোনও বালাই নেই। বন্ধুর দেশের বাড়ি দেখার ঝোঁকে ওরা যে কতটা ঝুঁকি নিয়ে ফেলেছিল, সেটা ওরা জানেই না।” আপাতত ঘরের ছেলেদের ঘরে ফিরিয়ে তবেই স্বস্তি পুলিশের।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Juveniles Rescued Onda Juvenile Care Home
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE