Advertisement
০৪ মে ২০২৪

নিঃসঙ্গদের বাড়িতে গিয়ে বিজয়া পালন কীর্ণাহারে

কেউ স্বামীকে হারিয়েছেন দীর্ঘ দিন আগে, কেউ বা স্ত্রীকে। কেউ বা শয্যাশায়ী হয়ে পড়ে রয়েছেন একলা ঘরে। ওঁদের অধিকাংশেরই দিন কাটছে নিঃসঙ্গতায়!

বিজয়ার শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন সমিতির সদস্যেরা। — সোমনাথ মুস্তাফি।

বিজয়ার শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন সমিতির সদস্যেরা। — সোমনাথ মুস্তাফি।

অর্ঘ্য ঘোষ
শেষ আপডেট: ২১ অক্টোবর ২০১৬ ০১:৪৩
Share: Save:

কেউ স্বামীকে হারিয়েছেন দীর্ঘ দিন আগে, কেউ বা স্ত্রীকে। কেউ বা শয্যাশায়ী হয়ে পড়ে রয়েছেন একলা ঘরে। ওঁদের অধিকাংশেরই দিন কাটছে নিঃসঙ্গতায়!

স্বজন, পরিবারের লোকেরা ছাড়া বিজয়ার প্রণাম তো দূরের কথা, কেউ দেখাও করতে আসেন না। এ বারই প্রথম চেনা ছবি গেল বদলে। এই প্রথম পায়ে হাত রেখে তাঁদের বিজয়ার প্রণাম করলেন একসঙ্গে অনেক মানুষ। দু’দণ্ড বসে গল্প করলেন। জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘কেমন আছেন? ঠিক মতো খাওয়াদাওয়া করছেন?’’ প্রতি উত্তর দিতে গিয়ে কিংবা গল্প করতে করতেই নস্টালজিয়ায় ওঁরা অনেকেই ভিজিয়ে ফেললেন চোখের কোণ! বৃহস্পতিবার আবেগ এ ঘন দৃশ্য কীর্ণাহার প্রবীণ সমিতির বিজয়া সম্মিলনীর।

সংস্থার জন্ম ২০১৬ সালে। বর্তমানে সদস্য সংখ্যা শতাধিক। প্রথম বিজয়া সম্মিলনীতেই অভিনব উদ্যোগ নেন সমিতির সদস্যরা। ঠিক হয়, যেসব বৃদ্ধ-বৃদ্ধা বার্ধক্যের কারণে বাড়ি থেকে বের হতে পারেন না, নিঃসঙ্গ তাঁদের কাছে গিয়েই বিজয়ার প্রণাম করে আসবেন তাঁরা।

দীর্ঘ দিন আগে স্বামীকে হারিয়েছেন স্থানীয় ভদ্রকালীতলা পাড়ার ৭৮ বছরের মায়ারানী চক্রবর্তী। বার্ধক্য জনিত কারণে শয্যাশায়ী হয়েই দিন কাটে তাঁর। একই অবস্থা বছর পনের আগে স্ত্রীকে হারানো প্রাক্তন স্কুল শিক্ষক ৭৯ বছরের মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়েরও। দীর্ঘ দিন শয্যাশায়ী হয়ে রয়েছেন প্রাক্তন স্কুল শিক্ষক ৯০ বছরের হারাধন প্রামাণিক, ৭৬ বছরের বংশীবাদক কান্ত যশ। এ দিন প্রবীণ সমিতির সদস্যরা গলায় উত্তরীয় পড়িয়ে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে মিষ্টির প্যাকেট এগিয়ে দিতেই কেউই চোখের জল ধরে রাখতে পারেননি।

আবেগে আপ্লুত প্রবীণরা।

‘‘যখন ছোট ছিলাম দল বেঁধে পাড়ার সবার বাড়ি প্রণাম করে নাড়ু মিষ্টি খেয়ে আসতাম। এখন তো সে সব রীতি উঠে গিয়েছে। আত্মীয় স্বজন, পরিবারের লোকেরা ছাড়া প্রণাম দূরে থাক, খোঁজ নিতেও কেউ একটা বড়ো আসে না। তাই মনে হত বোধ হয় মরেই গিয়েছি। আজ যেন পুনঃজন্ম হল।’’ বলছিলেন এক বৃদ্ধ।

বিজয়ায় বাদ পড়েননি প্রান্তজনেরাও। কোমরের আঘাত জনিত কারণে বছর পাঁচেক ধরে শয্যাশায়ী হয়ে রয়েছেন ভ্যানচালক ৬৫ বছরের বাবলু দাস, ৮২ বছরের দিনমজুর নিমাই কোনাই। এ দিন তাঁদের বাড়ি গিয়ে যথাযোগ্য সম্ভাষণ জানাতেই প্রবীণ সমিতির সদস্যদের জড়িয়ে ধরেন নিমাইবাবুরা। প্রবীণ সমিতির কানাইলাল মণ্ডল, আবু লায়েশ মল্লিক, পঞ্চানন মণ্ডলরা সম্ভাষণ শেষে নিমাইবাবুদের মুখে নিজেদের আনা মিষ্টি তুলে দিতে যেতেই বাড়ির থেকে তাঁদের জন্যও চলে আসে প্লেট ভর্তি নাড়ু। মিষ্টি মুখ শেষে বিদায় নেওয়ার মুহুর্তে কারও চোখই কার্যত শুকনো ছিল না।

নিমাইবাবু বলেন, ‘‘বাড়িতে এসে আমাদের কেউ তো কোনওদিন বিজয়ার সম্ভাষণ জানিয়ে যায়নি। আজকের দিনটি আমাদের কাছে স্মৃতির সঞ্চয় হয়ে থাকবে।’’

পঞ্চাননবাবুরা বলেন, ‘‘প্রতিবারই এ ভাবেই বিজয়া করতে আসব।’’ সমিতির সভাপতি সুকুমার দাস এবং সম্পাদক অসীম বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘নিজেদের অভিজ্ঞতা থেকেই বুঝেছি বয়স যত বাড়ে ততই অন্যের সান্নিধ্য পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা তীব্র হয়। কিন্তু এখন সচরাচর বৃদ্ধবৃদ্ধাদের কাছে কেউ ঘেঁষতে চাই না। তাই বাইরের চেনা পৃথিবীর স্বাদ তাঁদের কাছে হারিয়ে যেতে থাকে। নিজেদের মূল্যহীন মনে করে নিঃসঙ্গ জীবন কাটান অনেকে। বছরের একটা দিন অন্তত তাঁদের কাছে চেনা পৃথিবীটা ফিরিয়ে দেওয়ার জন্যই এই উদ্যোগ।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Lonely loners Vijaya celebration
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE